হুমকির মুখে জনগণের স্বাস্থ্য
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রাজনীতি
এ কে এম মাকসুদ, শামীমুল ইসলাম শিমুল, এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম
গবেষণা প্রবন্ধটির উদ্দেশ্যঃ এই গবেষণা প্রবন্ধটি তৈরী ও তা উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো, যে যে কারণসমূহ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলো চিহ্নিত করে তার একটি তালিকা তৈরী করা, বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী বিষষমূহ সৃষ্টি হবার কারণসমূহ বর্ণনা করার জন্য সহায়ক সুনির্দিষ্ট গবেষণা তথ্য সন্নিবেশিত করা এবং স্বাস্থ্যের জন্য এসব হুমকি দুর করার উপায় খোঁজার আলোচনার সূত্রপাত করতে সহায়তা করা।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রাজনীতি
এ কে এম মাকসুদ, শামীমুল ইসলাম শিমুল, এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম

২. গবেষণা পদ্ধতিঃ এই গবেষণা প্রবন্ধটি তৈরীর জন্য বিভিন্ন সেকেন্ডারী সোর্স (ংবপড়হফধৎু ংড়ঁৎপবং) থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যেমনঃ সরকারী স্বাস্থ্য প্রতিবেদন, সরকারী/বেসরকারী জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদন, গবেষণা জার্নাল, বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজীতে প্রকাশিত প্রধানত ৩টি দৈনিক প্রত্রিকার প্রতিবেদন (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক প্রথম আলো এবং দি ডেইলী ষ্টার)।
৩. স্বাস্থ্য উন্নয়নে দেশের সাম্প্রতিক অর্জনসমূহঃ বিভিন্ন উন্নয়ন নির্দেশকের নিরিখে বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। যেমন ১৯৮০ সালে যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হার ছিল শতকরা ৩.৮ ভাগ তা ২০১১-১২ সালে এসে দাড়িয়েছে ৬.২৩। ১৯৮৩-৮৪ সালে যেখানে দারিদ্র সীমার নীচে ৬২.৬% মানুষ ছিল তা ২০১০ সালে কমে দাড়িয়েছে ৩১.৫%। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছিল ৩.০% হারে। ঐ সময় প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ২৬০ জন এবং প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৩০০০ জন। এরপর বাংলাদেশে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সালে ছিল ৩২২ জন যা আবারও ৯ বছরে ২০১০ সালে কমে এসেছে প্রতি লাখে ১৯৪ জনে। বর্তমানে এদেশে জনসংখ্যার শতকরা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%। এদেশে বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৬৭.৭ , যা ১৯৭৫ সালে ছিল ৪৬ বছর। ১৯৭৩ সালে শিশু মৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৭৩ জন। ১৯৮৫/৮৬ সময়কালে জন্মের সময় কম ওজন নিয়ে (ঁহফবৎবিরমযঃ) শিশু জন্মের হার ছিল শতকরা ৭২ ভাগ , যা বর্তমানে এসে দাড়িয়েছে শতকরা ৩৬ ভাগে । বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার কমে এসে দাড়িয়েছে ৫৩ জনে। বর্তমানে শিশু প্রসবের সময় ৩১.৭%-এর ক্ষেত্রে প্রসবকাজে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকে। টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ৮২.৯% শিশুকে সবকটি মারাতœক রোগের টিকাদান করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য উন্নয়নের সাম্প্রতিক অর্জনসমূহ অবশ্যই বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে।
৪. স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও জনবলঃ স্বাধীনতাউত্তর ৪২ বৎসরে এদেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য জনবল তৈরিতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশে বর্তমানে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইতিমধ্যে ৪৫৯ টি হাসপাতাল রয়েছে এবং জেলা, বিভাগ ও রাজধানী মিলে আরও ১২৪টি হাসপাতাল রয়েছে এবং এ হাসপাতালগুলোতে সর্বমোট ৪১,৬৫৫টি বেড রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রসারে সরকারের রয়েছে ২১টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। সব মিলিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ৯২,৯২৭ জন জনবল কর্মরত রয়েছে। এছাড়াও সরকার সম্প্রতি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ১২,৯৯১ জন কমিউনিটি হেল্্থ কেয়ার প্রোভাইডার নিয়োগ দিয়েছে। সরকারের পরিকল্পিত ১৮,০০০ কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ১১,৮১৬টি চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও জনবল নিয়োগও বেড়েছে ক্রমাগতভাবে। বর্তমানে মোট রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের শতকরা ৬৮ ভাগ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত। বেসরকারি উদ্যোগে দেশে গড়ে উঠেছে ২,৯৬৬ টি বেসরকারি রেজিষ্টার্ড হাসপাতাল/ক্লিনিক। যদিও রেজিষ্ট্রেশন বা সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চলছে আরও অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক। ইতিমধ্যে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ১৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, ৮৩টি বেসরকারি হেল্্থ টেকনোলজি ইন্সটিটিউট।
৫. স্বাস্থ্য সেবা গ্রহনের পরিস্থিতিঃ স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যূরোর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যার পরামর্শ ও সেবা নেবার জন্য বাংলাদেশের মানুষদের শতকরা ২৩.৪ ভাগ ওধুধের দোকান বা ফার্মেসিতে যায়, শতকরা ১৯.৭ ভাগ মানুষ পরামর্শ ও ওধুধের জন্য গ্রাম্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, শতকরা ১৬.২ ভাগ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এমবিবিএস বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেন, শতকরা ৯.০ ভাগ মানুষ প্রাইভেট ক্লিনিকে যায়। অপরপক্ষে শতকরা ১২.১ ভাগ মানুষ উপজেলা হাসপাতাল, শতকরা ৯.০ ভাগ মানুষ জেলা হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যায় এবং শতকরা ৪.১ ভাগ মানুষ সরকারি কমিউনিটি কিøনিক বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যায়। আইসিডিডিআরবি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ শারীরিক অসুস্থতার কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যায় এবং মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ শারীরিক অসুস্থতার কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যায়। যদিও বাংলাদেশে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানী পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবাদানের জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাদান কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে ও বহু দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখনও দেশের ৪৩.১% মানুষকে কেন ফার্মেসী ও ডিগ্রীবিহীন ডাক্তারের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধের ব্যবস্থাপত্র নিতে হচ্ছে তা বিবেচনার দাবি রাখে।
৬. পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাঃ এখনও এদেশে ৩৬% শিশু বয়সের তুলনায় ওজন কম হয় (ঁহফবৎবিরমযঃ)। এছাড়াও এখনও বাংলাদেশের শতকরা ৪১ ভাগ শিশু ও ৪২ ভাগ ১৫-৪৯ বছর বয়সের বিবাহিত নারীরা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। গবেষণা তথ্যে আরও পাওয়া যায় যে, ১৫-৪৯ বছর বয়সের বিবাহিত নারীদের শতকরা ২৪ ভাগ অপুষ্টিতে (ইগও < ১৮.৫) ভুগছে। উন্নয়নের অনেক নির্দেশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভাল হলেও দেশে পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে অগ্রগতি হতাশাজনক। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, ১৯৪৩ সালে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল তার কারণ কোন অবস্থাতেই দেশে ‘খাদ্যের অভাবে অনাহারে মৃত্যু’ ছিল না বরং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হারানো, মুদ্রাস্ফীতিই ও খাদ্য নিয়ে সীমাহীন অসাধু ব্যবসাই ছিল দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। সমসাময়িককালেও চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন এ সবের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল এবং এখনও ঘটছে। এ সবের কারণে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনার ক্ষমতা হারিয়েছে অন্যদিকে পরিবারের সবাইকে ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হতে হচ্ছে। টাকার অংকে মানুষের আয় হয়তো বেড়েছে কিন্তু খাদ্য ক্রয়ের ক্ষমতা বেড়েছে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন।
৭. দারিদ্র ও স্বাস্থ্যঃ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রামক ও জীবাণুবাহিত রোগ, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের প্রকোপ ধনী ও শিক্ষিতদের তুলনায় অনেক বেশি। অন্য এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, ৭ ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা যাকে দারিদ্রের কারণে সৃষ্ট রোগ-ব্যাধি বলে আখ্যায়িত করা হয় যেমনঃ যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি ও এইডস, মাতৃত্বজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা, হাম, শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ ও ডায়রিয়া, যে রোগ-ব্যাধিগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এগুলো প্রতিরোধ করা গেলে মানব সমাজের রোগ-ব্যাধির বোঝাও দ্রুত কমে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে উপরিউক্ত ৭ ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যাই এশিয়া ও আফ্রিকার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক এক সময় বলেছিলেন যে, উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলোর মানুষেরা পৃথিবীর রোগ-ব্যাধির ৯০% বোঝা বহন করে কিন্তু পৃথিবীতে স্বাস্থ্যের জন্য যে সম্পদ ব্যয় হয় তার মাত্র ১০% তাদের জন্য ব্যবহার হয়।
৮. স্বাস্থ্য খাতে ধনী-দরিদ্র এবং গ্রাম-শহর বৈষম্যঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার (প্রতি হাজারে) ধনিক শ্রেণীতে ৪৩ আর দরিদ্র শ্রেণীত ৮৫। ধনিক শ্রেণীর পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে এই হার দ্বিগুণের বেশি, ৫৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ধনী পরিবারের শিশুমৃত্যুর হার দরিদ্র পরিবারের শিশুদের চেয়ে অনেক কম। প্রসবের সময় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ধাত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের সহায়তা গ্রামের চেয়ে শহরের মায়েরা বেশি পান। নিরাপদ প্রসব এবং প্রসূতি ও নবজাতকের সুস্থতার জন্য গর্ভবতী অবস্থায় চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে দরিদ্র শ্রেণীর মাত্র ৭ শতাংশ গর্ভবতীকে চারবার পরীক্ষা করানো হয়। পক্ষান্তরে ধনিক শ্রেণীর মধ্যে এই হার ৪৭ শতাংশ। একইভাবে মাত্র ৫ শতাংশ দরিদ্র প্রসূতি প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান। আর ধনী প্রসূতিদের ৫১ শতাংশ এই সহায়তা পান। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। গ্রামের মাত্র ১৩ শতাংশ মা প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান। শহরে এই হার ৩৭ শতাংশ। চারবার প্রসব-পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেন গ্রামের ১৪ শতাংশ গর্ভবতী। শহরে এই হার ৩৭ শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার (প্রতি হাজারে) গ্রামে ৭৬, আর শহরে ৬২। গ্রামের পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৫ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। শহরে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ।
৯. চিকিৎসা খরচের বোঝা বহনে দরিদ্র মানুষের অক্ষমতাঃ বাংলাদেশে প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে বিগত ৯০ দিনের অসুস্থ্যতার ইতিহাস নিয়ে হিসাব করলে দেখা যায় যে গড়ে ১৭২ জন মানুষ অসুস্থ্য থাকে (সড়ৎনরফরঃু ৎধঃব)। ঐ গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, মানুষ একবার রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ্য হলে গড়ে ৫০০ টাকার বেশি খরচ করতে হয়। তাই হিসাব করে দেখা গিয়েছে যে নি¤œ আয়ের পরিবারগুলোর একবার কেউ অসুস্থ্য হলে তার চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ বাবদ পরিবারের মোট আয়ের শতকরা ৪০ ভাগ খরচ হয়ে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে রোগাক্রান্ত হলে একদিকে যেমন একজন আয় করতে পারছে না অন্যদিকে রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে অর্থাভাবে খাবার, ঘরভাড়া, সন্তানদের শিক্ষা খরচের মত মৌলিক মানবিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে না।
১০. অবহেলিত সরকারি স্বাস্থ্যখাত এবং স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যক্তিখাতের বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ সম্প্রসারণঃ সম্প্রতি হেলথ ওয়াচের একটি জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক গড়ে প্রতিটি রোগীর পেছনে সময় দেন মাত্র ৫৪ সেকেন্ড। সরকারি হাসপাতালে মাঝে মধ্যে ডাক্তারের দেখা পেলেও তারা রোগীকে ২/১ মিনিটের বেশি সময় দেয় না। রোগী ও রোগীর স্বজনদের সাথে করেন দুর্ব্যবহার। সেই একই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে গেলে রোগী ও তার আতœীয়-স্বজনদের মনোযোগ দিয়ে আর আদর করে স্বাস্থ্য সমস্যার কথা শুনে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়ার পাশাপাশি ভালভাবে খোঁজ খবর নেন। ফলে রোগীরা সরকারি হাপতালালের পরিবর্তে ঐ চিকিৎসকদের চেম্বার ও ক্লিনিকেই যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
২০০৭-০৮ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের ৬.৬% বরাদ্দ ছিল। ২০১১ সাথে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু সর্বনি¤œ ৪৪ ডলার বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু বরাদ্দ ২১ ডলার। চলতি অর্থ বছরে এ বরাদ্দ না বাড়িয়ে উল্টো কমানো হয়েছে। চলতি বছর এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৪.৯%। সরকারি হাসপাতালগুলোতে লোকবল ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অভাব বা বিকল থাকার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এ সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামাফিক অর্থ আদায় করছে। সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ডিউটিরত ডাক্তারদের পাওয়া যায় না। আর এ কাজটি কখনো কখনো ওয়ার্ড বয় কিংবা সুইপার দ্বারা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাত ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে, অপরপক্ষে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে ব্যক্তিখাতে স্বাস্থ্য বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা ও অবকাঠামো। এর ফলশ্রুতিতে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করার নীতি বাস্তবায়নের পরিবর্তে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর নীতি-আদর্শের অনুসারী হয়ে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট কেটে-ছেটে স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে তথাকথিত স্বাস্থ্য বানিজ্যের ব্যাক্তিখাতের মুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর।
১১. গ্রাম বিমুখ ডাক্তার-নার্স ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবাঃ ‘বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০৪’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪২.০২ শতাংশ ডাক্তারই তাদের কর্মস্থলে অনুপুস্থিত থাকেন। আপগ্রেডেড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টারগুলোতে ৭৪% ডাক্তার উপস্থিত থাকেন না। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ২০১০ ও ২০১১ সালে সরকার ৪১৩৩ জন অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক)চিকিৎসকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে নিয়োগ দেয়। কিন্তু নিয়োগ পাওয়ার ১ বছরের মাথায় গ্রাম ছেড়ে শহরের হাসপাতালে চলে এসেছেন অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ ডাক্তার। তবে তারা বেতন ভাতা তুলছেন ইউনিয়ন থেকেই। গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু ঐ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ কখনোই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক থাকেন না। তারা আসেন আবার বদলি নিয়ে চলে যান শহরে। যেমন, মনপুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের ১২ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে সেখানে কর্মরত রয়েছে মাত্র ১ জন চিকিৎসক। এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারী চিকিৎসা সেবা।
১২. ক্রয়-দূর্নীতি: উচ্চমূল্যে কেনা চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি ও ওষুধের অপব্যবহারঃ সরকারি হাসপাতালে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ক্রয়ের নামে বিপুল অর্থ লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৩০ টাকা দামের ইনজেকশন ৪৮০ টাকা, ৬২ টাকার ইনজেকশন ২০০ টাকা, ১২ টাকার ট্যাবলেট ২৫ টাকায় কেনা হয়েছে। এমনি করে ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে ১৬ ধরণের ইনজেকশন, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনেছে একটি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ কর্ত্তৃপক্ষ। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২,১৩,১৬,১০০ টাকা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সার্ভে ২০০৮ এর ফলাফলে দেখা যায়, সরকারের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচির আওতায় যত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল, তার ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। ১৬ শতাংশ যন্ত্রের মোড়কই খোলা হয়নি। ১৭ শতাংশ নষ্ট। বাকি ১৭ শতাংশ ব্যবহারের উপযোগী হলেও ব্যবহার করা হয় না।
১৩. ডায়াগনষ্টিক ল্যাব, নার্সিংহোম ও ক্লিনিকগুলোর অবাধ স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যঃ সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মত যত্রযত্র গড়ে উঠেছে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসা। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এ সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ রোগ নির্ণয়ের কাজ। মনগড়া রিপোর্ট তৈরির মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে অহরহ। টেষ্টের ফিও ইচ্ছামত নেয়া হচ্ছে, এখানে মানা হয় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত ফি রাখার বিধান। রোগী রেফারকারী ডাক্তারকে দেয়া হয় মোট ফি এর ৬০-৬৫ শতাংশ। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই হাসপাতালে ৮০ টাকা দিয়ে ইসিজি করার ব্যবস্থা থাকলেও ঐ হাসপাতালেরই ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় রোগীদের একই টেস্ট হাসপাতাল পার্শ্ববর্তী ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে করিয়ে আনতে হয় ২০০ টাকা খরচ করে। এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে চিকিৎসকরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রোগীদের অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে থাকেন।
১৪. অনুমোদনহীন ব্লাড ব্যাংকগুলোর অপতৎপরতা এবং রক্তবাহিত রোগের লাগামহীন বিস্তারঃ বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী দেশে ব্লাডব্যাংকের ৮১%-ই অনুমোদনহীন। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য একজন রক্তগ্রহিতাকে কমপক্ষে ৫টি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ৫০% কেন্দ্রে এইসব পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নাই। ফলে ওই কেন্দ্র হতে সরবরাহকৃত রক্ত গ্রহণ সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে দেশে অনেক ব্লাড ব্যাংকই অবৈধভাবেই চলছে সেখানে রক্তের পরিসঞ্চালনে ৫টি প্রাণঘাতি রক্তবাহিত রোগের জীবাণু পরীক্ষা করা যে হয়না এবং তার মনিটরিং করার যে কোন ব্যবস্থা বর্তমানে এদেশে নেই তা সহজেই অনুমেয়।
১৫. রোগী কেনা-বেচার বাণিজ্যঃ রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে চলছে রোগী কেনা-বেচার মত দুখঃজনক ঘটনা। আর এই রোগী কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত দালাল চক্র। আর এসব দালালের সঙ্গে সর্ম্পক রয়েছে বহু নামী-দামি ডাক্তার, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। দালালদের ভাগ না দিলে রোগী পাওয়া যায় না। আর রোগী না পেলে হাসপাতাল, আসিইউ, ডায়ালাইসিস সেন্টার চলবে কিভাবে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আসিইউতে রোগী দিলে দালালদের রোগী প্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা, আইসিইউতে অবস্থানকালে প্রতিদিন ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, অপারেশন হলে রোগীদের থেকে আদায়কৃত মোট অর্থের ২০%-৩০% ভাগ, শয্যা ভাড়ার ২০%-৩০% সহ আদায়কৃত মোট অর্থের একটি বড় অংশ চলে যায় দালালদের হাতে। অভিযোগ রয়েছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউ নামক টাকার ফাঁদে যদি একবার ফেলা যায় তবে ভিটেমাটি, গাড়ি-বাড়ি বিক্রি করেও রক্ষা পাওয়া যাবে না।
১৬. ওঝাঁ-বৈদ-হাতুড়ে ও ভূয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম ও অজ্ঞ ও দরিদ্র মানুষদের অসহায়ত্বঃ ঝাড়-ফুকের নাম করে চিকিৎসা করতে গিয়ে ওঝাঁ-বৈদ্যেরা প্রায়ই রোগী বিশেষত শিশু-কিশোর-কিশোরীদের ছ্যাঁকা দিয়ে, পুড়িয়ে বা দূর্ঘটনায় ফেলে দিয়ে মারছে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোকে এমবিবিএসসহ বিভিন্ন ডিগ্রির পরিচয়ধারী লোকজন এনে অপচিকিৎসা দেয়ায় প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। খোদ রাজধানীতে চলছে হাতুড়ে দন্ত চিকিৎসা। রাস্তার ধারে বসেই প্রয়োজনে একটি প্লায়ার্স দিয়ে টেনে উপড়ে ফেলে রোগীর দাঁত। যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণের কোন বালাই নেই। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এক শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন পদ্ধতির চিকিৎসার কথা বলে দিনের পর দিন অপচিকিৎসা ও প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের প্রায়ই দেখা যায় ফুটপাত বা রাস্তার ধারে বৃত্তাকার লোকের জটলার (মজমা) মাঝ থেকে মাইকে নানা অঙ্গভঙ্গিতে আকর্ষণীয়ভাবে বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও সর্বরোগ নিরাময়কারী ওষুধের কথা বলে যেতে। তার সামনে হরেক রকমের গাছের বাকল, শিকড়, ফল বা কোন প্রাণির দেহের অংশবিশেষ। অনেকে চিকিৎসায় রোগ সেরে যাবার ১০০% গ্যারান্টি এবং বিফলে পিুরো টাকা ফেরৎ দেবার গ্যারান্টি দেয়। এ ধরণের চটকদার কথাবার্তায় বা বিজ্ঞাপনে সহজ-সরল মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে তাদের ওষুধ কিনতে প্রলুদ্ধ হয়ে অপচিকিৎসার শিকার হন। এই প্রতারকরা মূলত: স্বাস্থ্য মোটা-তাজা ও সুশ্রী করা, যৌন সমস্যা, হাঁপানি, দাঁতের ব্যথা, অর্শ, গেজ, ভগন্দর, জন্ডিস, এইডস, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করে। স্বল্পমূল্যে সুচিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে প্রথমে রোগীদের নিয়ে আসা হয়, এরপর নানা বাহানায় টাকা নিয়ে কাল্পনিক ওষুধ দিয়ে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১৭. পরিবেশ বিপর্যয় ও স্বাস্থ্য সংকটঃ বাংলাদেশে নদীনালা, খাল-বিল পুকুরসহ জলাশয় দখল ও দুষণের কারণে সুপেয় পানির আধার ধ্বংস হয়ে পানি সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া জলাশয় দখল ও দুষণের শিকার হওয়ায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। উপকূলীয় এলাকার খাবার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ থাকায় সেখানকার মানুষ উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বিকল হওয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগে ভূগতে শুরু করেছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৪২০৬ টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। সিটি কর্পোরেশনের ট্রাকগুলো বর্জ্য-এর একটি বড় অংশ অপসারণ করার পরও প্রতিদিন ১৭০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। এই বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করছে যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। হাজারীবাগের ১৮৫টি চামড়াশিল্প থেকে গড়ে ৭৫ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য নির্গত হয় এবং নির্গত হয় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই একটি কারখানাতেও।
তাই তা ছড়ায় বাতাসে, বুড়িগঙ্গার পানিতে, এমন কি ভূগর্ভের পানিতেও। ট্যানারি শিল্পের বিষাক্ত রাসায়নিক দূষণে রাজধানীর ২০ লাখ মানুষ চরম ঝূঁকিতে রয়েছে। অসহনীয় এই দূষণে সেখানে দেখা দিয়েছে নানা রোগ। এই শিল্পের সাথে জড়িত ৫০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজারই এই ভয়াবহ দূষণের নীরব শিকার। দূষণের কারণে শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে স্কিন ক্যান্সার, যক্ষ্মা, বুকে ব্যথা, জন্ডিস, হাঁপানিসহ নানা জটিল রোগে। রাজধানীর দেড় হাজারের বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার চিকিৎসা বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯২% বর্জ্য রাস্তার উপর খোলা ডাস্টবিনে, নর্দমা বা সরাসরি নদী-খালে ফেলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ বর্জ্যরে সাথে এসব মেডিক্যাল বর্জ্য মিশে গেলে সংক্রামক ব্যাধি খুব দ্রুত ছড়ায়। এক ভাইরোলজিষ্ট-এর মতে, পয়োঃনিষ্কাশন লাইনের ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে টাইফয়েড ও আমাশয়ের মতো পানিবাহিত রোগের জীবাণু বহুদিন বেঁচে থাকে এবং অনেক জায়গায় দেখা গেছে পয়োঃনিষ্কাশনের লাইনের দূষিত পানির পাইপ ছিদ্র হয়ে মিশছে ওয়াসার সরবরাহ করা পানির সঙ্গে। রাজধানীতে আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। একাধিক জরিপে দেখা গেছে ঢাকা শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা ৬০ ডেসিবেল থেকে শুরু করে কোন কোন স্থানে ১০৬ ডেসিবল পর্যন্ত রয়েছে। অতিমাত্রায় শব্দের মধ্যে বসবাস করলে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা হতে পারে।
১৮. খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার ও ভেজাল খাদ্যঃ বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল চলছে বিপুল লাভজনক ও অনেকটা বাধাহীনভাবে এবং শাস্তির কোন ভয়-ডর ছাড়াই। অনেক বিক্রেতা বা উৎপাদক এটাকে তারা কোন অপরাধই মনে করছে না। বাচ্চাদের অতি প্রিয় চিপস, চকলেট, আইসক্রিম ও আচারেও দেদারসে মেশানো হয় ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক পদার্থ। অধিকাংশ হলুদের গুড়ায় মেশানো হয় লেড ক্রোমেট, মেটানিল ইয়েলো যা অতি দ্রুত লিভার ধ্বংস করে। গাড়ির ফেলে দেওয়া মবিল দিয়ে বানানো হচ্ছে “খাঁটি ও ঝাঁঝাঁলো সরিষার তেল”। ভেজাল ও ক্ষতিকারক খাবারের দ্রুত বিপুল পরিমাণে বিক্রি ও আকাশচুম্বি মুনাফা করতে বারবার টিভি ও রেডিও চ্যানেলে দিয়ে চলেছে লোভনীয়, চটকদার অথচ অসত্য বিজ্ঞাপন।
মাছ-মাংস, শাক-সবজি ও ফলমূলসহ নানা খাবারে ফরমালিন মিশিয়ে এবং সেগুলো বাজারজাত করে বিক্রির মাধ্যমে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই ফরমালিন থ্রোট ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সার, শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগসহ বিভিন্ন চর্মরোগের জন্ম দিতে পারে। ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা কিডনি, লিভার, প্রস্টেট ও ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। বাজারে চড়া দামে বিক্রির জন্য কীটনাশক ব্যবহার করে কাঁচা আম দ্রুত পাকিয়ে তা বিক্রি করা হয়। আনারস বড় হলে তখন তাতে হলুদ রং ধরানোর জন্য কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয় ফলে এসব আনারস খেলে মানুষের ক্যান্সার হতে পারে বা লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বেশি লাভের আশায় মৌসুম শুরু হবার আগেই কচি কাঁঠালে নির্বিচারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথ্রায়েল, কপার সালফাইড, পটাসের তরল দ্রবণ, রাইপেন ও ইথিফন জাতীয় বিষাক্ত পদার্থ।
খাবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিরিয়ানি, জিলাপি, বেগুনি, পিঁয়াজু, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারেও যে রং ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ রংগুলি লিভার এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে ও বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারের জন্ম দিতে পারে। এছাড়া টারট্রাজিন এবং ইরাইথ্রোসিন নামক রংগুলো মসলা, আখনি, ফলের জুস, মুসুরির ডাল এমনকি তেলকে রঙিন করার জন্য ব্যবহার করা হয় যা ক্যান্সার, চর্মরোগ এবং বিভিন্ন ধরণের শ্বাসকষ্টজনিত রোগের জন্ম দিতে পারে। মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরিতে চিনির পরিবর্তে স্যাকারিন ব্যবহার করা হয় যা শরীরে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ।
বর্তমানে মানুষের মৃত্যুর একটি বড় কারণ খাদ্যশষ্যে রাসায়নিক ব্যবহার। কৃষিতে চলছে মাত্রাতিরিক্ত হারে কীটনাশক, সার ও আগাছানাশক রাসায়নিক বিষের ব্যবহার। কৃষিতে এসবের ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে বেড়ে চলেছে ক্যান্সার, নিউরোপ্যাথি, কিডনি, লিভার ও হার্ট ডিজিজ। কৃষিতে এসবের ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অস্বাভাবিকতা, এন্ডোক্রাইন, হরমোন, প্রজনন ও ¯œায়ুতন্ত্র ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটছে। পোল্ট্রি খামারের মুরগিতে আর খামারের মাছে মাত্রাতিরিক্ত রোগ প্রতিরোধক ওষুধ প্রয়োগ ও পোল্ট্রি-ফিস ফিডের সাথে অতিরিক্ত মাংসবর্ধক ওষুধ-ইনজেকশন প্রয়োগের কুপ্রভাব মানুষের শরীরে কতখানি ও কিভাবে পড়ছে তা এখনো অজানা।
১৯. মোটাতাজাকৃত গরুর মাংস খাওয়াতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিঃ এক শ্রেণীর বেপারী মুনাফার লোভে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মোটা-তাজাকরণের ওষুধ খাইয়ে দেদারসে গরু বিক্রি করে। একজন লিভার বিশেষজ্ঞ বলেন, ষ্ট্রেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাইয়ে গরু মোটা-তাজা করা হয়। পাশাপাশি ইউরিয়া ও রাব খাওয়ানো হয়। এ সকল ওষুধ ও কেমিক্যাল প্রয়োগকৃত গরুর মাংস খেলে লিভার নষ্টসহ জটিল রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস হয়ে হাড় ভেঙ্গে যাওয়া, চোখে ছানি পড়া ও বুদ্ধিজনিত ঘাটতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া চেহারা সুন্দর ও নাদুস-নুদুস হবার জন্য এক শ্রেণির তরুণীরা গরু মোটা-তাজাকরণের (ডেকাসন, ওরাডেক্সন, বিকাসন ইত্যাদি) ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। ঐ সকল তরুণীদেরও অনুরূপ রোগব্যাধি ও জটিলতা হওয়ার আশংকা রয়েছে।
২০. ফর্সা হওয়া ও মোটাতাজা হবার জন্য প্রশাধনী-মেডিসিন ও মারাত্মক রোগের ঝুকিঁঃ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের মতে, বিষাক্ত মার্কারি সংমিশ্রণে তৈরি ত্বক ফর্সা ক্রিম ব্যবহারে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। মায়েরা অস্বাভাবিক শিশুর জন্ম দিতে পারে। তাছাড়া ব্যবহারকারীর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বাড়ে, হতাশা বাড়ে। উপরন্ত, গোসল ও হাতমুখ ধোয়া পানি মার্কারিযুক্ত হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে খাবার পানি ও মাছের মাধ্যমে তা মানবদেহে ঢুকে অনুরূপ রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
২১. মাদক সেবনঃ অনুমান করা হয় যে, সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখ। এক হিসাবে মাদকাসক্তরা বছরে ৮ হাজার ২১৩ কোটি টাকা ব্যয় করে। হেরোইন, ইয়াবা, আইসপিল, গাঁজা, মদ, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক অবৈধভাবে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে। এক হিসাবে প্রতি বছর ভারত থেকে ১৬শ’ কোটি টাকার ফেনসিডিল চোরাই হয়ে আসে। এই ব্যবসার সহায়ক হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রশ্রয়। এসব মাদকের পুরোটাই আসছে অবৈধভাবে বিদেশ থেকে। আর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও স্থানীয় অসাধু রাজনৈতিক নেতা এসব জায়গায় অর্থ লগ্নি করে। ১৯৯৯ সালের এক হিসাবে দেখা গিয়েছিল যে, এ দেশের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য ৮৫.২ কোটি ডলার খরচ করত কিন্তু একই সময়ে এ দেশের মানুষই ধুমপান করার জন্য বৎসরে ১০৫ কোটি ডলার খরচ করত। তাই দেখা যাচ্ছে, মানুষ তার অতি প্রয়োজনীয় বিষয় অর্থাৎ স্বাস্থ্যের জন্য যা খরচ করছে, তার চেয়েও অনেক বেশি খরচ করছে স্বাস্থ্যক্ষতির পেছনে।
২২. পশু-পাখি থেকে মানুষের মাঝে রোগের সংক্রমণঃ প্রতি বছর পশু-পাখি থেকে গড়ে তিনটি নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রভাবশালী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট এ তথ্য দিয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৭২ বছরে মানুষ প্রায় ৪০০ নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। এ সব ব্যাধির ৬০%-এর উৎস পশু বা পাখি। মানুষ আক্রান্ত হবার আগ পর্যন্ত একটি জীবাণু সর্ম্পকেও বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। ঐ গবেষণা সাময়িকীতে বলা হয় যে, পশু-পাখি থেকে আসা রোগে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে অ্যানথ্রাক্স, টোক্সোপ্লাজমোসিস, ব্রুসেলোসিস, র্যাবিস, কিউ ফিবার, চ্যাগাস ডিজিজ, রিফট ভ্যালি ফিভার, সার্স, ইবোলা হেমোরোজিক ফিভার, নেইল ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, এইচআইভি, নিপাহ ভাইরাস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েনজা, সোয়াইন ফ্লু প্রভৃতি। বাংলাদেশ এসব রোগের ঝূকির মধ্যে রয়েছে।
২৩. সড়ক দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু ও প্রতিবন্ধী মানুষ তৈরীঃ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকারি হিসেব গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪,৯১৮ জন যা গড়ে বছরে ৩৪৯১ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ২০০০০ বেশি মানুষ। দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৬ লাখ। আর বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। বাকি ৫ লাখের বেশি চালক অবৈধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালকের ভুলের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। ভূয়া বা লাইসেন্সবিহীন চালক বা অযোগ্য হয়ে যাওয়া চালক সবাই বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি ও হাজার হাজার মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ।
২৪. ভেজাল ও নকল ওষুধের অবাধ বাণিজ্য এবং অসহায়দের অপমৃত্যুঃ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, নামী দামি কোম্পানির ওষুধ নকল করে দীর্ঘদিন যাবৎ বাজারজাত করে আসছে এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান ও লোকজন। এছাড়াও দেশে আকাশ ও স্থল পথে বিদেশ থেকে ব্যাপক হারে আসছে জীবন রক্ষাকারী নকল ও ভেজাল ওষুধ। নি¤œমানের এ সব ওষুধ সেবনে মৃত্যুও হার বেড়ে চললেও এই নিয়ে কোন মনিটরিং নেই। এই সকল নি¤œমানের ও ভেজাল ওষুধের মার্কেট গ্রামাঞ্চলে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের একজন অধ্যাপক বলে যে, শুধু ১৯৯২ সালে প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে তিন শতাধিক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ধরা পড়ে। তবে এদেশে ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ কিংবা খাদ্যসামগ্রী খেয়ে কেউ মারা গেলে বিচারের কোন নজির নেই।
২৫. ভুল ওষুধ প্রয়োগ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঃ ১৯৯০ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ভুল ওষুধ সেবন ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, ১৫ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের মত একটি অনুন্নত দেশে ভেজাল বা ভূলভাবে ওষুধ খাবার কারণে কত মানুষ মারা যাচ্ছে তার হিসেব কি এদেশে আছে? বাস্তব সত্য হলো এ ধরণের কোন পরিসংখ্যান বাংলাদেশে এখনও নাই। ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বা মৃত্যুর পেছনে কাজ করে মূলত: চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত এবং রোগী কর্তৃক গৃহীত ভুল ও ক্ষতিকর ওষুধ। বিশ্ব জুড়েই ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের উৎকোচ বা বিভিন্ন ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অকার্যকর, ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ওষুধের অতিমাত্রায় প্রেসক্রাইব করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
২৬. বিষাক্ত রাজনীতি-প্রশাসন ও বিষাক্ত ওষুধঃ কেরানীগঞ্জের কাশেম আহমেদ (ছদ্ম নাম) দীর্ঘদিন যাবৎ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করে আসছে আটা, ময়দা ও নানা রকমের ক্যামিকেল দিয়ে। এভাবে বছরের পর বছর দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারী ওষুধ বাজার মিটফোর্ডে নকল, ভূয়া ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করতো। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর ছত্রছায়ায় সে ৫ টাকা দামের ওষুধ বিক্রি করতো ২০ থেকে ১০০ টাকায়। কেমিষ্ট এন্ড ড্রাগিষ্ট সমিতি সূত্রে জানা যায় যে, এর আগে কাশেমকে নকল, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ উৎপাদন করে বাজারজাত করায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে দ্রুত ছাড়া পেয়ে পুনরায় নকল, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রকাশ্যে পাইকারী বিক্রি করতে থাকে। এ সব ওষুধ রাজধানীসহ সারাদেশে ওষুধের খুচরা ব্যবসায়ীরা নিয়ে বিক্রি করে থাকে। কাশেমের কোটি কোটি টাকার আয়ের ভাগ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন ও সন্ত্রাসীরা নিয়মিত পেয়ে থাকে।
২৭. ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসনের অক্ষমতা এবং লাগামহীনভাবে ওষুধের দাম বেড়ে চলা আর দরিদ্র মানুষের ওষুধ কেনার অক্ষমতাঃ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ২ টাকা দামের হিষ্টাসিন ট্যাবলেটের দাম ৩ টাকা বাড়িয়ে ৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ২ টাকার রিবোফ্লোবিন বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়, ২ টাকার রিবোসনের দাম দাঁড়িয়েছে ৫ টাকায়। তিনটি ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধি ১৫০ শতাংশ। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি প্রনয়ণের পর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর করালগ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছিল দেশের ওষুধবাজার। কিন্তু বিগত দুই দশকে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চরিত্র ধারণ করেছে।
ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বাজারে জেনেরিক নামের ২২০০ ওষুধ রয়েছে। এগুলোই বিভিন্ন কর্মাশিয়াল নামে (ব্রান্ড নামে) বাজারজাত হচ্ছে, যার সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। অথচ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মাত্র ২০৯টি জেনেরিক নামের ওষুধের (কর্মাশিয়াল বা ব্রান্ড নামে প্রায় ৫ হাজার) মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অন্যদিকে জেনেরিক নামের বাকি ১৯৯১টি অর্থাৎ কমার্শিয়াল নামের প্রায় ৪০ হাজার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনের কারণে বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাত করা প্রায় ৪০ হাজার ওষুধের মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর’। এ আদেশের ফলে ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়ায় তারা ইচ্ছেমত ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৮ বছর যাবৎ কোম্পানিকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট নিন্মমানের ওষুধ বাজারজাত করে শত শত কোটি টাকা কামিযে নিচ্ছে। অন্যদিকে ভেজাল ও নি¤œমানের হোমিওপ্যাথিক ওষুধে বর্তমানে দেশের হোমিও বাজার সয়লাব। ঐ হোমিও ওষুধ আমদানি, উৎপাদন ও বাজারজাতকণের কোন নীতিমালা না থাকায় পরিস্থিতি অধিককতরও জটিলরূপ ধারণ করেছে।
দেশে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত ওষুধগুলোর গুণগত মান জানার জন্য দেশে আছে মাত্র দুটি পরীক্ষাগার। প্রতিষ্ঠান দুটিতে কাজ করছেন ৫৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওষুধ প্রশাসনে ৭৪৫ জন লোকবলের প্রয়োজন; কিন্তু আছে মাত্র ১২২ জন। প্রশাসন সূত্র বলছে, দেশের ৬৪টি জেলায় একজন করে ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক (ড্রাগ সুপার) প্রয়োজন কিন্তুু আছে মাত্র ২৯ জন। সারা দেশে এ্যালোপেথিক, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, ভেষজ এ সব মিলে দেশে ৮০০ ওষুধ কারখানা আছে আর ওধুধের দোকান আছে প্রায় ৩ লাখ-এর মত। তাই এই বিস্তৃত এলাকা ও ইউনিটসমূহ কিভাবে এত কম জনবল তদারক করবেন। ওষুধ প্রশাসনের অবকাঠামোগত সমস্যা ও জনবল স্বল্পতার কারণে বাজারে নকল, ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ ছেয়ে যাচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তরের পরিচালকের মতে, দেশ থেকে ৭০-৭১টি দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল না থাকলে এই বাজার বাড়ানো সম্ভব হবেনা।
২৮. ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বাণিজ্য এবং ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ও অযৌক্তিক ব্যবহার বৃদ্ধিঃ সম্প্রতি হেল্্থ ওয়াচের একটি জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে মোট ৬০০০ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। তবে এক ওষুধ বিশেষজ্ঞের মতে, এর অর্ধেকটাই অর্থাৎ ৩০০০ কোটি টাকার ওষুধ অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। তবে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির পরিমান বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ওষুধ বিক্রি হলে কোম্পানির লাভ, চিকিৎসকদের লাভ। তাই ওষুধ বিক্রি না বাড়ার কোনই কারণ নেই। তবে এ সময়কালে মানুষের রোগ ৪ গুন বেড়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে? ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য তাদের বিক্রয় প্রতিনিধিদের ওপর প্রচন্ড চাপ দেয়। নিজেদের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখানোর জন্য দেশের প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধি চিকিৎসকদের নানাভাবে প্রলুদ্ধ করেন, পুরস্কৃত করেন। তারা এখন সারা দেশের পল্লী চিকিৎসকদেরও এ কাজে ব্যবহার করছে। এ সব কারণে ডাক্তারগণ রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ওষুধ লিখছেন। আইন অনুযায়ী কোন ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান বৈধ ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া পরিচালনার সুযোগ নেই। দেশে মোট ইস্যুকৃত ড্রাগ লাইসেন্সের সংখ্যা ৯৮ হাজার। তবে বাস্তবে দেশে রয়েছে ৩ লাখের বেশী ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান। এ রকম দোকানদাররা আর পাশ না করা ডাক্তাররাও জড়িয়ে গিয়েছে চিকিৎসাসহ ওষুধ ব্যবসার সিন্ডিকেটের সাথে ও মুনাফার লোভের সাথে। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করাও সরকারের জন্য দুরুহ কাজ। যদি এদরকে আইনী কাঠামোর মধ্যে না আনা যায় তাহলে ওষুধের বিশেষত: এ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং ভেজাল ওষুধের বাজারজাতকরণ কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। অনেক ভালো ওষুধ কোম্পানি ওই সিন্ডিকেটের ঘুষ প্রদানের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পথে বসে গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সৎ ওষুধ উৎপাদক, ক্রেতা কারো পক্ষেই ঐ সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভবনা।
২৯. অত্যাবশকীয় ঔষধের সরবরাহ এবং দারিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঃ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ। জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে অবশ্যই অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যদিও বাংলাদেশে এখন বাজারে ৪০০০০-এরও বেশি ওষুধ রয়েছে কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে মাত্র ২২০টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ দিয়েই একটি দেশের প্রায় সমস্ত রোগ-ব্যাধির চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে ঐ ২২০টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধই প্রয়োজনের সময় এই পৃথিবীর ৩০% মানুষ পায় না বা জরুরি প্রয়োজনে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাও নেবার ক্ষমতা রাখে না।
৩০. প্রয়োজনীয় ওষুধ আবিস্কার ও উৎপাদনে আগ্রহ কম এবং অপ্রয়োজনীয় লাভজনক ওষুধের উৎপাদনে ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো নির্মানে উৎসাহঃ দেশে ওষুধ উৎপাদনের প্রধান লক্ষ্য এখন জনগনের চিকিৎসার প্রয়োজনে নয়, ওষুধ উৎপাদিত হয় ব্যবসায়িক স্বার্থে, মুনাফা অর্জনের জন্য। অথচ পরিকল্পিতভাবে উৎপাদিত সামান্য ওষুধ এ গরীব জনগণকে অহেতুক যন্ত্রণা ও অর্থহীন মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি দিতে পারত। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ওষুধ উৎপাদনের একটি বড় অংশ হলো ভিটামিন, আয়রন টনিক, কাশি/ঠান্ডার ওষুধ, টনিক বলবর্ধক ও মোটা হওয়ার ওষুধ, এনজাইম ও হজমীকারক, এন্টাসিড ও মানসিক রোগের ওষুধ। অথচ এন্টিবায়োটিক, পরজীবী ও কৃমি-বিধ্বংশী ওষুধ, বিবিধ চর্মরোগ ইত্যাদির উৎপাদন অনেক কম, যদিও এগুলো এদেশের মানুষের জন্য অধিক প্রয়োজন। দরিদ্রদের প্রয়োজনীয় অথচ লাভ কম হয় এমন ওষুধ গবেষণা করে বের করতে বা উৎপাদনে দেশের ওষুধ কোম্পানীগুলোর তেমন কোন উৎসাহ চোখে পড়ে না। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলোর সরকার ও বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত মৌলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়, দামী অথচ অপ্রয়োজনীয় কিন্তু লাভজনক ওষুধ উৎপাদনে বেশি আগ্রহী।
৩১. দালাল চক্র কর্তৃক হাসপাতালে সন্ত্রাস, শোষণ ও ভুয়া চিকিৎসাঃ সাম্প্রতিক এক পত্রিকা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, এসএসসিও পাশ করনি এমন এক দাগী অপরাধী পঙ্গু হাসপাতালের দালালদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে ও রোগী ভাগিয়ে নেয়া বাণিজ্যের পাশাপাশি আগারগাও এলাকায়ই পঙ্গু হাসপাতালের অর্থপেডিক্্েরর অধ্যাপক নাম ধারণ করে স্থানীয় এক ক্লিনিকে নিজেই চালিয়ে যাচ্ছিল প্রাইভেট প্রাকটিস ও অপারেশন। কত শত রোগীকে যে সে অপারেশন করেছে তার হিসাব নাই। এর পাশাপাশি সে গড়ে তোলে দালালদের একটি শক্তিশালী চক্র। দালাল চক্রকে ৬০% কমিশন দিয়ে থাকেন ঐ ভূয়া অধ্যাপক। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদেরও দিতেন প্রতিমাসে মোটা অংকের চাঁদা যারা ছিল তার নেপথ্য ক্ষমতার উৎস। হাসপাতাল কর্ত্তৃপক্ষ জীবন রক্ষার্থে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাত।
৩২. চিকিৎসায় অবহেলাঃ একটি ক্লিনিকে এক অপারেশনের সময় এক রোগীর কিডনিটাই কেটে ফেলেন এক ডাক্তার। রোগীর স্বজনদের দাবি, ঐ ক্লিনিক কর্ত্তৃপক্ষ ওই চিকিৎসকের যোগসাজসে হয়তো কিডনি বিক্রি করে দিয়েছে। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, অনেক ডাক্তারই রোগীর অপারেশণ করার বদলে ভুলে তার কিডনিটি কেটে ফেলেন। এ ছাড়া হাসপাতালে মেয়াদউত্তীর্ণ স্যালাইনের কারণে একই রাতে কয়েকজন রোগীর মৃত্যু, ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় চোখ হারানো এসব খবর পত্রিকায় প্রায়ই বের হচ্ছে। চিকিৎসা অবহেলার কারণে ক্ষতি বা মৃত্যু হলে কি ক্ষতিপুরন বা শাস্তি হবে তা নিয়ে বাংলাদেশে সরাসরি কোন আইন নাই।
৩৩. অহেতুক অস্ত্রোপচার ও জবরদস্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবা-অমানবিক বাণিজ্যের এক আগ্রাসী রূপঃ সম্প্রতি প্রকাশিত জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে বলা হয়েছে, ১০০টি প্রসবে ১৭টি হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। কিন্তু দাকোপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এই হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব হয় ৮৮টি এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হয় ৯০টি। অভিযোগ উঠেছে, সিজারিয়ান অপারেশন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা আয়ের কারণেই এসব অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, হাসপাতাল কর্ত্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী বিল পরিশোধ করতে না পারায় হাসপাতালেই শিশুর লাশ ফেলে চলে গেছেন কৃষক পিতা।
৩৪. কিডনি ক্রয়-বিক্রয় বাণিজ্য - মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ীদের লালসাঃ জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার অন্তত ২০ গ্রামের দুই শতাধিক অভাবি মানুষ দালাল চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের কিডনি বিক্রি করেন। রাঘবপুর গ্রামের দরিদ্র আলতাফ বলেন, “অভাব ঘোঁচাতে মাত্র দেড় লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছিলাম।” মেহেদী, তার কলিজার (লিভার) একটি অংশ বিক্রি করে তার দারিদ্র ঘোঁচাতে চেয়েছিল। মেহেদিকে এই বলে ডাক্তাররা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে তার কলিজার যে অংশটুকু বিক্রির জন্য কেটে নেয়া হবে তা আবার ৩-৪ মাসের মধ্যেই গজিয়ে যাবে। মেহেদী তার কলিজার একটি টুকরা ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে।
৩৫. প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সমস্যা ও চিকিৎসাঃ দেশে বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। বাংলাদেশে ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সের মানুষ এখন এক কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। এক হিসাব মতে ২০৩০ ও ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে শতকরা ১২ ও ২২ ভাগ। প্রবীণদের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর। তবে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের চিকিৎসাসেবার পৃথক ব্যবস্থা দেশের সরকারি বা বেসরকারি কোন হাসপাতালে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে সংকট তৈরি হতে পারে। উপরন্তু, বাংলাদেশে বার্ধক্যজনিত রোগ চিকিৎসা ও সেবা যতেœর জন্য প্রশিক্ষিত জনবলেরও অভাব রয়েছে।
৩৬. বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি বাণিজ্যঃ এক বছরে ভর্তি ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা নিয়েছে দেশের ৫২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। ফি নির্ধারিত না থাকায় ইচ্ছামত টাকা আদায় করছে কলেজগুলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন যে, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে ফি নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। বেসরকারি কলেজগুলোতে ভর্তি ফি সরকারি কলেজগুলোর চেয়ে গড়ে ১২৫ গুণ বেশি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এ বছর ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা মাত্র আর অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে নেওয়া হচ্ছে ১৩ লাখ টাকা উপর। রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারের মত একটি মাত্র বিল্ডিং-এর কয়েকটি কক্ষে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ খুলে ডাক্তার হবার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ ছাড়াই দ্রুতহারে যে ডাক্তারি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে সেই ডাক্তারদের চিকিৎসাদানের মান কি তা নিয়ে প্রশ্ন করাটা জরুরি এবং কে ও কিভাবে এই ডাক্তারদের যোগ্যতার পরিমাপ মনিটরিং করছে তা জানা জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য অধিকতরও জরুরি।
৩৭. অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বনাম বঞ্চিত স্বাস্থ্য খাতঃ ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৯৯-২০০০ সাল সময়কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের শতকরা হার বিবেচনায় প্রায় অপরিবর্তিত ছিল (প্রায় ৫%) কিন্তু এসময়কালে সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছিল প্রায় দ্বিগুণ (৯.৫% থেকে ১৭.৫% হয়েছিল)। সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ালে দেশ দ্রুত উন্নতি করতে পারত। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে সে সময়কার সরকার ১০০০ কোট টাকা দিয়ে (১৭৮ মিলিয়ন ডলার) রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ যুদ্ধবিমান কিনেছিল আর ৫৫০ কোটি টাকা (১০০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে কোরিয়া থেকে ১ টি ফ্রিগেড কিনেছিল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঐ সরকার যদি ঐ পরিমান টাকা দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র না কিনে সেই টাকা দেশের সামাজিক উন্নয়ন খাতে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ইত্যাদি) ব্যয় করত তাহলে বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নির্মূল করা যেত, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো যেত (হাজারে ৪.৩৩ জন থেকে ১.৫ জনে), শিশু মৃত্যুর হার কমানো যেত (হাজারে ৫৭ থেকে ৩৫-এ), ২০ বছরের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫,০০০ জন শিক্ষকের নিয়োগ দেয়া যেত।
৩৮. স্বাস্থ্য খাতের সুশাসনঃ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থানীয় চাহিদাগুলো বুঝে এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্য প্রশাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে বিকেন্দ্রিকৃত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলে তা স্থানীয় মানুষের চাহিদা এবং স্থানীয় সম্পদের বিবেচনায় স্বাস্থ্য পরিকল্পনা করা সহজ হতো।
৩৯. প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে অবহেলাঃ মূলধারার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না হয়ে অনেকটাই ডাক্তার-হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার কেন্দ্রিক শহুরে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। যে ব্যবস্থাটি দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ বিশেষত: ৫০ ভাগ দরিদ্র মানুষের জন্য মোটেই সহায়ক ও সহনীয় নয়। আজ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কেবিনগুলো পাচঁতারকা হোটেলের বিলাসবহুল ব্যবস্থাকেও হার মানায় অথচ দেশের ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষকে জরুরি প্রয়োজনেও সামান্য ও সাধারণ চিকিৎসার খরচ বহন করতে হিমসিম খেতে হয়। বিশ্বনন্দিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডেভিজ ওয়ারনারের মতে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা মেডিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট হচ্ছে জনস্বাস্থের জন্য একটি বড় বাধা।
তুলনামূলকভাবে দরিদ্র রাজ্য হওয়া সত্বেও ঔষধ ব্যবহারের বদলে মূলত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধির উপর জোর দেওয়ায় সাধারণ অসুখে এই রাজ্যে মৃতের হার অনেক হ্রাস পায়। প্রতি হাজারে উত্তর প্রদেশে যেখানে শিশু মৃত্যুর হার ৬৭, সেখানে কেরালায় তা মাত্র ১২ (২০০৮ সালের পরিসংখ্যান মোতাবেক) এবং প্রতি লাখে উত্তর প্রদেশে যেখানে মাতৃ মৃত্যুর হার ৪৪০, সেখানে কেরালায় তা মাত্র ৯৫। কাজেই শুধু রোগ হলে ওষুধ খেয়ে রোগ সারানোর চিন্তা না করে বরং রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার, নিরাপদ পানি ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারের হার বাড়িয়ে রোগের হাত থেকে বাঁচা যায়। রোগ হলে ওষুধ খেলেই রোগীর রোগ মুক্তি হবে না বরং ওষুধ সেবনে রয়েছে মারাতœক ঝূঁকি। উন্নত বিশ্বে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর হার ৪র্থ স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ হার্ট এ্যাটাক, ক্যান্সার ও স্ট্রোক এর কারণে মৃত্যুহারের পরই এর অবস্থান।
ইতিহাস থেকেই বলা যায় যে, বাংলাদেশেও যদি বেশকিছু রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (টিকাদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার আচরণ পরিবর্তন, বর্জ্যর ব্যবস্থাপনা, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা) সময়মত না নেওয়া হতো তাহলে লাখ লাখ মৃত্যু পথযাত্রী শিশুকে রোগ হবার পর রোগ সারানোর জন্য চিকিৎসাসেবা দেওয়া দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল একত্রে মিলেও সম্ভব হতোনা। সেইসাথে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসমূহ কমিয়ে দিয়েছে রোগ হবার পর চিকিৎসার জন্য যে ডাক্তারের ফি, ওষুধ ক্রয়, ডায়াগষ্টিক টেস্ট, হাসপাতালের সিট ভাড়া, খাবার, যাতায়াত ইত্যাদি খরচ। রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাসমূহ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল নির্মাণের চেয়েও বেশি ফলদায়ক অর্থাৎ রোগ না হলে তো আর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ওষুধক্রয়, বিশাল বিশাল হাসপাতাল নির্মাণ, শত শত ল্যাব এবং জনে জনে রোগ সারানোর বিরাট খরচের বোঝা বহন করতে হবেনা।
৪০. “স্বাস্থ্য” - কি মানবাধিকার না একটি বাণিজ্যিক পণ্য? বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত, মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়। তবে প্রশ্ন হলো স্বাস্থ্য সেবা দেবার জন্য রাষ্ট্রের যে দ্বায়িত্ব তা সে কিভাবে পালন করবে? এই দ্বায়িত্ব রাষ্ট্র নিজের উপর না নিয়ে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবানিজ্যকারী মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান ও বাজার ব্যবস্থার উপর ন্যাস্ত করছে। স্বাস্থ্যসেবা বিক্রি করে অবাধ মুনাফা লোটার দ্বায়িত্ব ও সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধ কোম্পানি, এনজিওদের হাতে। নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাটা নাগরিকের অধিকার হিসেবে না দেখে সেটা বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে নিছক একটি পণ্য হিসেবে জনগণের কাছে বিক্রির চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন হলো, যারা এই স্বাস্থ্যসেবা কিনতে পারছে না তাদের জন্য রাষ্ট্র কি করবে?
সারা পৃথিবীতে দেশ হিসেবে আমেরিকায় জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। যার পরিমান প্রতিবছর জনপ্রতি ৭০০০ ডলার। আর কিউবা খরচ করে প্রতিবছর জনপ্রতি ২৫১ ডলার। আমেরিকা সরকারের স্বাস্থ্য খরচ কিউবা সরকারের চেয়ে ২৮ গুণ বেশি হওয়ার প্রেক্ষিতে মানুষের প্রত্যাশিত আয়ু বেশি হবার কথা। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভূত বিষয় হলো উভয় দেশের আয়ু প্রায় সমান। কিউবাতে ৭৭.৬ এবং আমেরিকাতে ৭৭.৫। কিউবাতে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৬.২ জন অথচ আমেরিকায় ৬.৮ জন। স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়ে এই বিশাল বৈষম্য সত্বেও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সূচকে আমেরিকা ও কিউবার তেমন কোন পার্থক্যই নেই কেন তার কারণ জানা জরুরি। ২৮ ভাগের এক ভাগ খরচ করেই যদি কোন দেশ তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আমেরিকার মত ভাল করতে পারে তাহলে স্বাস্থ্যের পেছনে ২৮ গুণ বেশি খরচ করে কি লাভ? অবশ্যই লাভ রয়েছে তবে সে লাভ রাষ্ট্রের জনগণের নয় বরং রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ধনিক গোষ্ঠীর, স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের। আর উপরোক্ত পার্থক্যের আরও একটি কারণ হলো আমেরিকায় “স্বাস্থ্য” হলো একটি লাভজনক পণ্য, বাজার যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপরপক্ষে কিউবাতে “স্বাস্থ্য” হলো একটি অলংঘনীয় মানবাধিকার এবং এই অধিকার রাষ্ট্র তার স্বাস্থ্য কর্মসূচি বিশেষত প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য কর্মসূচীর মাধ্যমে নিশ্চিত করে। তাই আজ আমাদের স্থির করা প্রয়োজন স্বাস্থ্যকে আমরা কী হিসেবে চিহ্নিত করবো। মানবাধিকার না বাণিজ্যিক পণ্য। স্বাস্থ্যকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হলে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা একটি শিল্পে পরিণত হবে। ফলে দিন দিন রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর এ খাতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্থ বিনিয়োগ ও মুনাফা বাড়তে থাকবে।
৪১. উপসংহারঃ এখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ছোট খাট স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়েও নামকরা হাসপাতালের বিখ্যাত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, ব্যয়বহুল ডায়াগনস্টিক টেস্ট করানো, বিদেশি দামি ওষুধ সেবন করার এক ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল স্বাস্থ্য সংস্কৃতির চালু হয়েছে। অনেকেই ভূলে গেছে যে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার খেয়ে, নিরাপদ পানি পান করে, নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে, নিয়মিত ব্যায়াম করে, স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাস্থ্যকে সুন্দর ও নিরোগ রাখা যায়। এর বদলে আজকে সবাই ভাবছে স্বাস্থ্যকে সুন্দর রাখতে হলে অবশ্যই স্বাস্থকে ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা করিয়ে, শরীরের নানা জটিল প্রযুক্তিনির্ভর দামি দামি মেডিক্যাল টেষ্ট করিয়ে, নিয়মিত দামি দামি ওষুধ খেয়ে সুস্থ্য রাখতে হবে। যার ফলশ্রুতিতে, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্র সকল মানুষের স্বাস্থ্যে বাসা বেধেছে নানা অসুস্থতা ও রোগ-শোক। এই ভগ্নস্বাস্থ্যই পরবর্তীতে পরিণত হয় স্বাস্থ্য বাণিজ্যের এক বিশাল শিল্পে। এ স্বাস্থ্য শিল্পকে ঘিরেই ডাক্তার, ক্লিনিক-হাসপাতাল ব্যবসায়ী, ওষুধ কোম্পানির মালিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মালিক সবাই মিলে গড়ে তুলেছে এক বিশাল বাণিজ্য সাম্রাজ্য।
দেশের স্বাস্থ্যখাতে কত ব্যয় হবে এবং এই খাত কিভাবে চলবে তা ঠিক করে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় আসার আগেই ঐ দল বলে দেয় যে, আগামী ৫ বছরে সেই দল স্বাস্থ্যখাত নিয়ে কি কি করবে। ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগ ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশনায় তাদের রূপকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে চলে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেশের ‘স্বাস্থ্য‘ হলো একটি রাজনৈতিক বিষয় - যার রোডম্যাপ ঠিক করেন রাজনীতিবিদগণ। তাই সরকারী ও বিরোধী দল সবাই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে জনগনের উন্নয়নে গনমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য না রাখলে স্বাস্থ্যখাত পরিনত হবে বিশাল এক বানিজ্যের বিষয়। স্বাস্থ্যই হলো দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের একমাত্র সম্বল ও সম্পদ তাই কোন অপরাজনীতি যদি তাদের স্বাস্থ্যকেই রুগ্ন বা রোগাক্রান্ত করে দূর্বল করে দেয় তাহলে তারা কি করে খেটে খাবে। তাই দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য ‘রাজনীতি’-কেই দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সহায়ক হতে হবে এবং এই লক্ষ্যে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের নিজের দাবীর কথা নিজেদেরই বলতে হবে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে ঠিকই তবে বর্তমানে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিরাজ করছে তাতে গরীব জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা অনেকাংশেই নিশ্চিত হয়নি। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে বেশি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা বলা যায় যে, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ মরিচিকা হিসেবেই রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এটাই ভাবা হতো যে কোন দেশের দৃঢ় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রভাবেই সেদেশের মানুষের স্বাস্থের উন্নয়ন হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৮ জন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নীতি-প্রণেতা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ গবেষণার মাধ্যমে ঐ প্রথাগত ধারণার বিপরীতটাই প্রমাণ করেছেন। অর্থাৎ কোন একটি দেশের জনগোষ্ঠীর উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ফলেই সেদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে জনগণের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হলে তা এ দেশের হাজার হাজার মানুষের জীবনই শুধু বাঁচাবে না বরং মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সম্পদের সাশ্রয়ও হবে।