বেপরোয়া চালনা, মৃত্যু যাত্রা
সৈয়দ মাহবুবুল আলম
প্রতিদিন সড়ক দূঘর্টনা হয়, তবে পত্রিকার হেড লাইন হলেই ব্যাপক সাড়া পড়ে। সাধারণত বিখ্যাত কোন মানুষের মৃত্যু না হলে সড়ক দুঘর্টনা বিশেষ গুরুত্ব পায় না নীতিনির্ধারকদের কাছে। বাসা থেকে বের হলেও সুস্থ্য শরীরে ফিরে আসবে কি না, সেই আংশকায় দিন কাটে আপনজনদের। সড়ক দুঘর্টনায় প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। ধনী-গরীব, রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী আর দেশের সাধারণ মানুষÑসবাই সড়ক দূঘর্টনার শিকার। কোন একটি দূঘর্টনার পর কয়েকদিন হৈচৈ হয়, তারপর চুপচাপ, কিন্তু কেন? কত মানুষের মৃত্যু হলে এই ঘুম ভাঙ্গবে?
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে হাজার কোটি ব্যয় হয় রাস্তা তৈরি, মেরামত আর বেতনভাতার কাজে। কিন্তু যাতায়াত নিরাপদ নিশ্চিতে কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। তবে সড়ক দূঘর্টনার পুরো দায় গতানুগতিকভাবে আমি সরকারের উপর ছেড়ে দিতে রাজি নই। যাত্রী, নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ সড়ক দূঘর্টনাকে কোন কোন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করছে। চালক আর যাত্রী উভয়েই আমরা রাস্তায় দ্রুত যেতে চাই। আমাদের এই মানসিকতা যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।
সড়ক দুঘর্টনার অনেক কারণ আছে। তবে আমি শুধু বেপরোয়া গতিতে চালনার পিছনের কারণগুলো তুলে ধরতে চাই। গবেষণায় দেখা যায় গাড়ীর দ্রুত গতির কারণে ৪০% সড়ক দূঘর্টনা হয়। শুধু সচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের চিন্তা মানে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া। বেপরোয়া গতির কারণে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম সাইনবোর্ড, স্প্রীড ব্রেকার আর সচেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি কেউ কেউ শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দূর্বলতা বা উদাসীনতা বলে উড়িয়ে দিতে চায়। গাড়ী বেপরোয়া গতির সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগসুত্র রয়েছে।
প্রথমেই অর্থনৈতিক যোগসুত্রের কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ অধিকাংশ গাড়ীর চালক ট্রিপ হিসেবে কাজ করে, যত ট্রিপ তত পয়সা। আর এ ট্রিপ তাদের গাড়ী চালানোর গতিকে বেপরোয়া করে। কম সময়ে ট্রিপ শেষ করা ও বেশি ট্রিপ করার চিন্তা নিয়ে চালকরা গাড়ি চালায়। কারণ বেশি ট্রিপ মানে বেশি টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ সময়কালে কম সময়ে বেশি অর্থপ্রাপ্তির চিন্তাকে খুব বেশি দোষও দেয়া যায় না। কিন্তু যখন অনেক মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমনকি স্বয়ং চালকের জীবনের নিরাপত্তাও যেখানে জড়িত, সেখানে বেপরোয়া গতির চাইতে নিয়ন্ত্রিত গতিই শ্রেয়। কিন্তু ট্রিপকেন্দ্রীক মজুরি বা সম্মানী বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনাকে উস্কে দেয়। এ ব্যবস্থার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
এটাও দেখা যায় যে, অনেক মালিক তাদের গাড়ি চালককে চুক্তির ভিত্তিতে দিয়ে দেয়। সারা দিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ মালিককে দিয়ে, বাকী টাকা চালক আর হেলপারদেরÑএ ব্যবস্থাও চালকদের বেপরোয়া করে তোলে। উপরন্তু, যানজট শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই বিরাজমান। যানজটও দ্রতগতিতে গাড়ি চালনাকে উৎসাহিত করে। কারণ, যানজটে যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়, সে সময় চালকেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পুষিয়ে নিতে চায়। এ দ্রুতগতিই শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক দূর্ঘটনার কারণ হিসাবে দেখা দেয়।
সিএনজি অটো রিকশার মালিক দৈনিক জমা বাড়ায়, চালকরা বেশি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে একদিকে বেশি ভাড়া আদায় করে, অন্যদিকে বেপরোয়া চালায়। বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। চলাচলের জায়গা কমেছে, কিন্তু রিকশা ভাড়া বেড়েছে। তার সাথে বেড়েছে রিকশা চালকদের বেপরোয়া চালনা। কম জায়গায় কম সময়ে বেশি রোজগারের চেষ্টা।
অর্থনৈতিক দিকটি পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে যায় রাজনৈতিক দিকটিও। কোন গাড়ীর মালিক চাইবে না তার আয় কমে আসুক। ড্রাইভার কিভাবে আয় করলো তা বিষয় না, দিন শেষে চাহিদামত টাকা পেলেই মালিক সন্তুষ্ট। গাড়ীর মালিক আর রাজনীতিÑএ’দুয়ের মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রীগণ অনেক কাজ করেছেন, কিন্তু গাড়ীর ভাড়া কমানো বা সঠিক ভাড়া আদায়ে মালিকদের বাধ্য করেছে পেরেছেÑতার নজির নেই। যোগাযোগ মন্ত্রীগণ জনগণের পক্ষে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু সিদ্ধান্তের সুবিধাভোগী হয় গাড়ীর মালিকরা।
দেশের বিভিন্ন রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা আছে, কিন্তু কেউ তা মানে না। না মানলে যাত্রী হিসেবে অভিযোগ করার কোন ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ স্থানেই গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নির্দেশনা নেই। ঢাকায় কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা কাজে আসেনি। ঢাকার রাস্তায় গাড়ীর বেপরোয়া চালনা চলছেই।
ঢাকার রাস্তায় যত পরিমাণ দূঘর্টনা হয় তার ৮৬% শিকার হন পথচারী। কোন পথচারী সড়ক দূঘর্টনার শিকার হলে প্রথমেই ফুটওভার ব্রিজের দাবি উঠে। কেউ একবারও ভেবে দেখে না, ঢাকার বিদ্যমান ফুটওভার ব্রিজগুলো কেন ব্যবহার হয় না? শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, ক্লান্ত পথিক, মহিলা, শিশু, রোগী বা মালবহনকারী ব্যক্তির পক্ষে ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব না। তবুও পথচারীদের নিরাপত্তার নামে, নির্যাতন সহায়ক ফুটওভার ব্রিজ হয়। গাড়ী চালকদের বেপরোয়া মনোভাব আরও বাড়ে, রাস্তায় পায়ে হেটে মানুষ কেন চলবে? যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যেন গাড়ীর চলাচলের পরিবেশ তৈরির জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। গাড়ী কিভাবে দ্রুত চলাচল করবে তাই তাদের পরিকল্পনা। তাই নিরাপদ যাতায়াত আর পথচারীদের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় স্থান পায় না।
গাড়ীর বেপরোয়া গতির জন্য যাত্রীরাও কম দায়ী নয়। অনেক সময় গাড়ীতে শুনতে পাওয়া যায় যাত্রীরা ড্রাইভারকে বলছে ‘‘ওই মিয়া গরুর গাড়ি চালাও নাকি। এত আস্তে তোমার গাড়ী চলে ক্যান, সব গাড়ী আগে চলে যাচ্ছে।’’ যাত্রীদের এই আগে যওয়ার মানসিকতাও ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ী চালনার জন্য প্রভাবিত করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানবাহনে যেতে কত সময় লাগবে সেই বিষয়টি হিসেব করে। কিন্তু যানবাহনে উঠা ও নামার সময়, রাস্তায় যানজটÑএ সময়গুলো হিসেবে আনে না। তাই রাস্তায় নামলেই দ্রুত যাওয়ার তাড়া!
তরুনরা এখন দ্রুত গতির গাড়ী কিনছে। শুধু নগরে নয়, মফস্কল ছড়িয়ে গেছে এই ফ্যাশান। কিনেই শেষ নয়, দ্রুত ছোটার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বিভিন্ন রাস্তায় বিকট শব্দে বেপরোয়াভাবে গাড়ী চলানো হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের। তাদের বেপরোয়া চালনায়ও দুঘর্টনা হচ্ছে।
বেপরোয়া চালানোর জন্য সড়ক দূঘর্টনা কি এভাবেই ঘটতে থাকবে? নাকি বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ দেখতে পাব? এ অনিশ্চিয়তা শুধু সাধারণ মানুষের জন্য নয়; ক্ষমতাশালী বা ক্ষমতাহীন সবাই অনিশ্চিয়তার শিকার। তাই বিষয়টি আর অবহেলা করা উচিত নয়। এ সমস্যা সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ নেয় উচিত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলÑউভয়ের এক সাথে কাজ করতে হবে। কারণ সড়ক দুঘর্টনা রোধে শ্রমিক বা মালিকদের কোন পক্ষ ক্ষুদ্ধ হলে, সরকারী বা বিরোধী দল যদি সে পক্ষকে সমর্থন দেয় তাহলে তা ভেস্তে যাবে।
বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ প্রয়োজন। গাড়ি চালকদের জন্য স্মার্ট আইডি কার্ড, ট্রিপের প্রথা বাতিল, মালিকদের একাউন্টে বেতনের টাকা প্রদানের ব্যবস্থা, ড্রাইভারদের চাকরির নিশ্চয়তা, গতি নিয়ন্ত্রণ নির্দেশক, অতিরিক্ত গতি চিহ্নিতকরণ মেশিন, এসিডেন্টের বা ট্রাফিক আইনভঙ্গের প্রেক্ষিতে ট্রাফিকদের শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা, একটি নির্দিষ্ট পরিমান নম্বর কাটার যাওয়ার জন্য লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল, অযোগ্য বা লাইসেন্স বিহীন চালকদের গাড়ী প্রদানের প্রেক্ষিতে গাড়ীর মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যবস্থা, পাবলিক পরিবহনগুলোর জন্য যাত্রী উঠানো এবং নামানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করা প্রয়োজন।
তবে বেপরোয়া গাড়ীর গতি চিহ্নিত করতে একটি টোল ফ্রি নম্বর থাকা প্রয়োজন। যে নম্বরটি বাধ্যতামূলকভাবে সকল গাড়ীতে থাকতে হবে। কোথায় কোন গাড়ী আইন ভঙ্গ করলে সাথে যে কোন নাগরিক দেশের যে কোন প্রান্ত হতে এ নম্বরে অভিযোগ প্রেরণ করতে পারবে। নাগরিকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশনা প্রদান করা হবে। তবে জনসচেতনতার মতো পদক্ষেপও তখন গ্রহণ করা প্রয়োজন। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি, তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের চালককে বেপরোয়া গতি থেকে বিরত রাখতে পারি। আসুন বেপরোয়া চালনার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি, দুঘর্টনার হার অবশ্যই কমবে।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম,
আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
সৈয়দ মাহবুবুল আলম
প্রতিদিন সড়ক দূঘর্টনা হয়, তবে পত্রিকার হেড লাইন হলেই ব্যাপক সাড়া পড়ে। সাধারণত বিখ্যাত কোন মানুষের মৃত্যু না হলে সড়ক দুঘর্টনা বিশেষ গুরুত্ব পায় না নীতিনির্ধারকদের কাছে। বাসা থেকে বের হলেও সুস্থ্য শরীরে ফিরে আসবে কি না, সেই আংশকায় দিন কাটে আপনজনদের। সড়ক দুঘর্টনায় প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। ধনী-গরীব, রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী আর দেশের সাধারণ মানুষÑসবাই সড়ক দূঘর্টনার শিকার। কোন একটি দূঘর্টনার পর কয়েকদিন হৈচৈ হয়, তারপর চুপচাপ, কিন্তু কেন? কত মানুষের মৃত্যু হলে এই ঘুম ভাঙ্গবে?
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে হাজার কোটি ব্যয় হয় রাস্তা তৈরি, মেরামত আর বেতনভাতার কাজে। কিন্তু যাতায়াত নিরাপদ নিশ্চিতে কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। তবে সড়ক দূঘর্টনার পুরো দায় গতানুগতিকভাবে আমি সরকারের উপর ছেড়ে দিতে রাজি নই। যাত্রী, নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ সড়ক দূঘর্টনাকে কোন কোন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করছে। চালক আর যাত্রী উভয়েই আমরা রাস্তায় দ্রুত যেতে চাই। আমাদের এই মানসিকতা যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।
সড়ক দুঘর্টনার অনেক কারণ আছে। তবে আমি শুধু বেপরোয়া গতিতে চালনার পিছনের কারণগুলো তুলে ধরতে চাই। গবেষণায় দেখা যায় গাড়ীর দ্রুত গতির কারণে ৪০% সড়ক দূঘর্টনা হয়। শুধু সচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের চিন্তা মানে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া। বেপরোয়া গতির কারণে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম সাইনবোর্ড, স্প্রীড ব্রেকার আর সচেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি কেউ কেউ শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দূর্বলতা বা উদাসীনতা বলে উড়িয়ে দিতে চায়। গাড়ী বেপরোয়া গতির সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগসুত্র রয়েছে।
প্রথমেই অর্থনৈতিক যোগসুত্রের কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ অধিকাংশ গাড়ীর চালক ট্রিপ হিসেবে কাজ করে, যত ট্রিপ তত পয়সা। আর এ ট্রিপ তাদের গাড়ী চালানোর গতিকে বেপরোয়া করে। কম সময়ে ট্রিপ শেষ করা ও বেশি ট্রিপ করার চিন্তা নিয়ে চালকরা গাড়ি চালায়। কারণ বেশি ট্রিপ মানে বেশি টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ সময়কালে কম সময়ে বেশি অর্থপ্রাপ্তির চিন্তাকে খুব বেশি দোষও দেয়া যায় না। কিন্তু যখন অনেক মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমনকি স্বয়ং চালকের জীবনের নিরাপত্তাও যেখানে জড়িত, সেখানে বেপরোয়া গতির চাইতে নিয়ন্ত্রিত গতিই শ্রেয়। কিন্তু ট্রিপকেন্দ্রীক মজুরি বা সম্মানী বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনাকে উস্কে দেয়। এ ব্যবস্থার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
এটাও দেখা যায় যে, অনেক মালিক তাদের গাড়ি চালককে চুক্তির ভিত্তিতে দিয়ে দেয়। সারা দিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ মালিককে দিয়ে, বাকী টাকা চালক আর হেলপারদেরÑএ ব্যবস্থাও চালকদের বেপরোয়া করে তোলে। উপরন্তু, যানজট শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই বিরাজমান। যানজটও দ্রতগতিতে গাড়ি চালনাকে উৎসাহিত করে। কারণ, যানজটে যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়, সে সময় চালকেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পুষিয়ে নিতে চায়। এ দ্রুতগতিই শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক দূর্ঘটনার কারণ হিসাবে দেখা দেয়।
সিএনজি অটো রিকশার মালিক দৈনিক জমা বাড়ায়, চালকরা বেশি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে একদিকে বেশি ভাড়া আদায় করে, অন্যদিকে বেপরোয়া চালায়। বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। চলাচলের জায়গা কমেছে, কিন্তু রিকশা ভাড়া বেড়েছে। তার সাথে বেড়েছে রিকশা চালকদের বেপরোয়া চালনা। কম জায়গায় কম সময়ে বেশি রোজগারের চেষ্টা।
অর্থনৈতিক দিকটি পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে যায় রাজনৈতিক দিকটিও। কোন গাড়ীর মালিক চাইবে না তার আয় কমে আসুক। ড্রাইভার কিভাবে আয় করলো তা বিষয় না, দিন শেষে চাহিদামত টাকা পেলেই মালিক সন্তুষ্ট। গাড়ীর মালিক আর রাজনীতিÑএ’দুয়ের মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রীগণ অনেক কাজ করেছেন, কিন্তু গাড়ীর ভাড়া কমানো বা সঠিক ভাড়া আদায়ে মালিকদের বাধ্য করেছে পেরেছেÑতার নজির নেই। যোগাযোগ মন্ত্রীগণ জনগণের পক্ষে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু সিদ্ধান্তের সুবিধাভোগী হয় গাড়ীর মালিকরা।
দেশের বিভিন্ন রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা আছে, কিন্তু কেউ তা মানে না। না মানলে যাত্রী হিসেবে অভিযোগ করার কোন ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ স্থানেই গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নির্দেশনা নেই। ঢাকায় কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা কাজে আসেনি। ঢাকার রাস্তায় গাড়ীর বেপরোয়া চালনা চলছেই।
ঢাকার রাস্তায় যত পরিমাণ দূঘর্টনা হয় তার ৮৬% শিকার হন পথচারী। কোন পথচারী সড়ক দূঘর্টনার শিকার হলে প্রথমেই ফুটওভার ব্রিজের দাবি উঠে। কেউ একবারও ভেবে দেখে না, ঢাকার বিদ্যমান ফুটওভার ব্রিজগুলো কেন ব্যবহার হয় না? শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, ক্লান্ত পথিক, মহিলা, শিশু, রোগী বা মালবহনকারী ব্যক্তির পক্ষে ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব না। তবুও পথচারীদের নিরাপত্তার নামে, নির্যাতন সহায়ক ফুটওভার ব্রিজ হয়। গাড়ী চালকদের বেপরোয়া মনোভাব আরও বাড়ে, রাস্তায় পায়ে হেটে মানুষ কেন চলবে? যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যেন গাড়ীর চলাচলের পরিবেশ তৈরির জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। গাড়ী কিভাবে দ্রুত চলাচল করবে তাই তাদের পরিকল্পনা। তাই নিরাপদ যাতায়াত আর পথচারীদের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় স্থান পায় না।
গাড়ীর বেপরোয়া গতির জন্য যাত্রীরাও কম দায়ী নয়। অনেক সময় গাড়ীতে শুনতে পাওয়া যায় যাত্রীরা ড্রাইভারকে বলছে ‘‘ওই মিয়া গরুর গাড়ি চালাও নাকি। এত আস্তে তোমার গাড়ী চলে ক্যান, সব গাড়ী আগে চলে যাচ্ছে।’’ যাত্রীদের এই আগে যওয়ার মানসিকতাও ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ী চালনার জন্য প্রভাবিত করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানবাহনে যেতে কত সময় লাগবে সেই বিষয়টি হিসেব করে। কিন্তু যানবাহনে উঠা ও নামার সময়, রাস্তায় যানজটÑএ সময়গুলো হিসেবে আনে না। তাই রাস্তায় নামলেই দ্রুত যাওয়ার তাড়া!
তরুনরা এখন দ্রুত গতির গাড়ী কিনছে। শুধু নগরে নয়, মফস্কল ছড়িয়ে গেছে এই ফ্যাশান। কিনেই শেষ নয়, দ্রুত ছোটার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বিভিন্ন রাস্তায় বিকট শব্দে বেপরোয়াভাবে গাড়ী চলানো হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের। তাদের বেপরোয়া চালনায়ও দুঘর্টনা হচ্ছে।
বেপরোয়া চালানোর জন্য সড়ক দূঘর্টনা কি এভাবেই ঘটতে থাকবে? নাকি বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ দেখতে পাব? এ অনিশ্চিয়তা শুধু সাধারণ মানুষের জন্য নয়; ক্ষমতাশালী বা ক্ষমতাহীন সবাই অনিশ্চিয়তার শিকার। তাই বিষয়টি আর অবহেলা করা উচিত নয়। এ সমস্যা সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ নেয় উচিত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলÑউভয়ের এক সাথে কাজ করতে হবে। কারণ সড়ক দুঘর্টনা রোধে শ্রমিক বা মালিকদের কোন পক্ষ ক্ষুদ্ধ হলে, সরকারী বা বিরোধী দল যদি সে পক্ষকে সমর্থন দেয় তাহলে তা ভেস্তে যাবে।
বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ প্রয়োজন। গাড়ি চালকদের জন্য স্মার্ট আইডি কার্ড, ট্রিপের প্রথা বাতিল, মালিকদের একাউন্টে বেতনের টাকা প্রদানের ব্যবস্থা, ড্রাইভারদের চাকরির নিশ্চয়তা, গতি নিয়ন্ত্রণ নির্দেশক, অতিরিক্ত গতি চিহ্নিতকরণ মেশিন, এসিডেন্টের বা ট্রাফিক আইনভঙ্গের প্রেক্ষিতে ট্রাফিকদের শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা, একটি নির্দিষ্ট পরিমান নম্বর কাটার যাওয়ার জন্য লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল, অযোগ্য বা লাইসেন্স বিহীন চালকদের গাড়ী প্রদানের প্রেক্ষিতে গাড়ীর মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যবস্থা, পাবলিক পরিবহনগুলোর জন্য যাত্রী উঠানো এবং নামানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করা প্রয়োজন।
তবে বেপরোয়া গাড়ীর গতি চিহ্নিত করতে একটি টোল ফ্রি নম্বর থাকা প্রয়োজন। যে নম্বরটি বাধ্যতামূলকভাবে সকল গাড়ীতে থাকতে হবে। কোথায় কোন গাড়ী আইন ভঙ্গ করলে সাথে যে কোন নাগরিক দেশের যে কোন প্রান্ত হতে এ নম্বরে অভিযোগ প্রেরণ করতে পারবে। নাগরিকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশনা প্রদান করা হবে। তবে জনসচেতনতার মতো পদক্ষেপও তখন গ্রহণ করা প্রয়োজন। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি, তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের চালককে বেপরোয়া গতি থেকে বিরত রাখতে পারি। আসুন বেপরোয়া চালনার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি, দুঘর্টনার হার অবশ্যই কমবে।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম,
আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)