Wednesday, March 5, 2014

হকার সমস্যা নয়, কর্মসংস্থান আর নিরাপত্তার ক্ষেত্র

পুরো ফুটপাত জুড়ে হকার থাকলে তা মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। আবার একেবারে ফুটপাত হকারমুক্ত করাও উচিত নয়, কারণ একদম ফাঁকা ফুটপাতে মানুষ নিরাপত্তাহীনতা ভোগে। কিন্তু ফুটপাতে হকারদের নির্দিষ্ট পরিমান জায়গা বরাদ্ধ করা হলে মানুষ নিরাপত্তার পাশাপাশি চলাচলে উৎসাহ বোধ করবে। ফলে একদিকে যেমন অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে, অপর দিকে যদি লাইসেন্সের মাধ্যমে যদি জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তবে তা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ভূমিকা
দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা বিশ্ব মাঝে ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় হয়েছে। সরকার নিরলসভাবে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে। কিন্তু জনগণের তুলনায় সম্পদের অপ্রতুলনতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব এ দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আর এ সকল প্রতিবন্ধকতাকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা, বেকারত্ব । বেকারত্ব নামক এই সমস্যাকে সামাল দিতে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আর তাই সরকারের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানহীনতার বিষয়টি গুরুত্বে সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কেননা সরকারের গৃহীত যে কোন সিদ্ধান্ত সরাসরি দেশের মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। উন্নয়নশীর দেশ হিসেবে আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতা/সীমবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের দেশের অনেক ব্যক্তির কর্মসংস্থান/কর্মকান্ড নিয়মতান্ত্রিক নয় বা গোছালো নয়, আর তার প্রেক্ষিতে এ সকল কার্যক্রম বন্ধ/উচ্ছেদ করে দেওয়ার পরিবর্তে হকারদের মতো পেশাগুলোকে স্বীকৃতি প্রদান এবং এ সকল কর্মকান্ডকে সুশৃঙ্খল করে কিভাবে জাতীয় অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করা যায় সে দিকেই লক্ষ্য করা উচিত।

বাংলাদেশ শহর অঞ্চলে হকার একটি অবহেলিত পেশা। হকার থাকা কতটুকু প্রয়োজন ফুটপাতে প্রতিদিন মানুষের ক্রয়ের ব্যস্ততা ও হকারদের বিক্রি দেখলেই অনুমান করা যায়। বিভিন্ন ধরনের সুবিধাই ফুটপাতে হকার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আমরা অনেকেই ফুটপাতে হকারদের অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন করে থাকি। কিন্তু একটু মনযোগের সাথে খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রতিদিন আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে কোন না কোনভাবে আমরা হকারদের উপর নির্ভরশীল। হকাররা ঢাকা শহরের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মিটিয়ে  চলেছে। বিগত দিনগুলোতে ফুটপাত হকারমুক্ত করতে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বা এখনো নিচ্ছে। ফুটপাত ও হকার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পুর্বে  অবশ্যই মূল সমস্যা চিহ্নিত ও সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করা উচিত।

হকারের পেশার প্রয়োজনীয়তা
ঢাকা শহরে প্রায় ১,৩০,০০০ হকার রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায় সম্বলহীন লোকেরা ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে এসে এই পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। যাদের গ্রামে কোন কাজ নেই্, নিজের জমি নেই, জমি গেছে নদীর ভাঙ্গনে। তারাই শহরে এসে কোনক্রমে একটু পয়সা জমিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেছে। এই পেশার মাধ্যমেই খুব ভাল করে না হলেও তাদের পরিবার নিয়ে জীবন কেটে যাচ্ছে। যেখানে রাষ্ট্র-সরকার প্রানান্ত চেষ্টা করেও মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদা পুরণের নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা, সেখানে এই ভাগ্যবঞ্চিত মানুষেরা নিজেদের প্রচেষ্টায় বাঁচার পথ খুজে নিয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন যে পেশা সেটিও হুমকির সম্মুখীন। এক্ষেত্রে প্রকৃতি নয়, রাষ্ট্র ও সরকার রুঢ় ভূমিকা ধারণ করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে হকারদের ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক দিক বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্য অনুসারে হকার ও তাদের সাথে সম্পৃক্ত লোকের সংখ্যা

বর্তমানে ঢাকা শহরের হকারের সংখ্যা   ১,৩০,০০০ জন
স্থায়ী  হকার  ৭০,০০০  জন
অস্থায়ী হকার  ৬০, ০০০ জন

পনের বছর ধরে ফুটপাতে ব্যবসা করতেছি। তিন ছেলে মেয়েসহ আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এই ব্যবসা দিয়াই আমার পরিবার চলে। ফুটপাতের ব্যবসা বন্ধ হইয়া গেলে আমার সংসার কি করে চলবে তা আমি চিন্তা করতে পারিনা। যারা ফুটপাত থিকা ব্যবসা উঠাইয়া দিবার কথা কয়, তারা চিন্তা করতে পারে না আমাদের জীবন কত কঠিন আর কি কইরা চলে। আমাদের বেঁচে থাকার শেষ উপায়টুকু যদি কাইড়া নেয়া হয় তা হইলে চুরি ছাড়া গতি নাই।
এরশাদ মিয়া, চা বিক্রেতা

অপরাধীরা সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা। অপরাধীদের দমন, নিয়ন্ত্রণ, সংশোধন করার জন্য সরকারকে আইন তৈরি, পুলিশ বাহিনী, জেলাখানা তৈরিসহ অনেক খাতেই খচর করতে হয়। সরকার এ সকল খাতে খরচ করছে। কিন্তু যারা নিজেরা পরিশ্রম করে ঘাম ঝড়িয়ে উপার্জন করে, তাদের সহযোগিতা না করা অযৌক্তিক নয় কি? অপরাধীদের নিয়ে পরিকল্পনা করার চেয়ে অপরাধী না হওয়ার জন্য পরিকল্পনা বা কার্যক্রম গ্রহন করা জরুরি। নাজমুল করিম

উচ্ছেদ নয়-প্রয়োজন সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান
ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা বা এ বিষয়ে আলোচনা/সিদ্ধান্তের পূর্বে ফুটপাতে হকার থাকায় কি ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নিয়মিত হেটে চলাচল করেন এমন ব্যক্তিদের কাছে ফুটপাতে হকার থাকার সমস্যা কি এ বিষয়ে জানতে চাইলে যেসব মন্তব্য শোনা যায়।

* হকাররা ফুটপাতের অনেকাংশ দখল করার ফলে চলাচল বিঘিœত হচ্ছে।
* কখনও কখনও হকারেরা ক্রেতাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে।
* ইচেছমতো জিনিস পত্রের দাম চেয়ে থাকে।
* ভ্রাম্যমান হকার বিক্রির জন্য পিছনে পিছনে ঘুরে বিব্রত করে  থাকে।

যদি আমরা উপরোল্লেখিত মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করি দেখা যাবে প্রথম কারণটিই অধিকাংশ মানুষ ফুটপাতে হকার থাকার সমস্যা বলে চিহ্নিত করে থাকেন। অন্যসব কারণগুলো শুধু হকার নয়, প্রায় বেশিরভাগ বড় মার্কেট বা দোকানেও রয়েছে। দেশের প্রতিটি বাণিজ্যিক ও সেবাখাত হতে ক্রেতা হিসেবে আমরা কোন অধিকার পাচ্ছি না। প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা নির্যাতিত, এমতবস্থায় আমাদের অবস্থান শুধুমাত্র একজন দর্শক হিসেবে।

একথা সত্য যে, কিছু কিছু রাস্তায় হকাররা ফুটপাতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থান করায় স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু এটি পুরো ঢাকা শহরের চিত্র নয়। নীলক্ষেত, হকার্স মার্কেট, গুলিস্থান এবং ফার্মগেট এলাকায় কিছু নির্দিষ্ট স্থানে ফুটপাতের অনেকাংশ হকারদের দখলে থাকায় চলাচলে বিঘœ ঘটছে। কিন্তু ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই ফুটপাতে হকার রয়েছে এবং ফুটপাতে পরিমিত পরিমাণ জায়গা নিয়ে ব্যবসা করছে সেক্ষেত্রে চলাচলে কোন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে না।

শুধুমাত্র হকার কর্তৃক পুরো ফুটপাত দখল হয়ে গেলেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হকারদের উচ্ছেদ না করেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। যদি তাদেরকে ফুটপাতে নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দের মাধ্যমে বসার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে এটি সমস্যা না হয়ে কর্মসংস্থানের একটি পথ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট মাজারের গেট পর্যন্ত ফুটপাতে অবস্থিত মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকানগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যদিও ঢাকা শহরে সকল ফুটপাতে এত বেশি পরিমাণ জায়গা নেই। তবে অনেক রাস্তায় তা সম্ভব, সেক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ফুটপাতের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।

বেকারত্ব নয়-কর্মসংস্থান সৃষ্টি
বর্তমানে বেকারত্ব বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। বেকার সমস্যা সমাধানে সরকারের আগ্রহ ও প্রচেষ্টা থাকলেও সমস্যা হ্রাস পায়নি বরং ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। হকাররা ঢাকা শহরের ফুটপাতে স্বল্প পুঁজি দিয়েই স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারছে।  তারা খাদ্য বস্ত্র বা অনান্য প্রয়োজনীয় উপকরন নিয়ে ছোট একটি দোকান সাজিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করছে। এই আয়ের উপর নির্ভর করে তাদের সংসার চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি কোন ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই তারা বেঁচে থাকার তাগিদে আয়ের পথ খুঁজে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরিকৃত রাস্তার একটি অংশ দখল করে ব্যবসা করছে। নাগরিক হিসেবে যেখানে রাষ্ট্র তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে তাদের বেঁচে থাকার এই ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের স্বাগত জানানো এবং উদ্যোগটিকে সুশৃঙ্খল ও সুন্দর ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার জন্য সহযোগিতা করা উচিত ।

অতীতে বিভিন্ন সময়ে ও বর্তমানে একরকম বিচার বিবেচনা ছাড়াই প্রায়শ হকারদের রাস্তা বা ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অনেকে ফুটপাত থেকে উঠিয়ে দিয়ে এদেরকে বিকল্প পুনর্বাসনের দাবি করে থাকেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের দেশে এখনো কর্মক্ষম জনশক্তির ৪০ শতাংই বেকার, ৯০ দশকে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ, গত ১০ বছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৩.৭ শতাংশ।  আমরা এখন পর্যন্ত তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি নি। যার ফলে আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বিরাজমান। এরপরও যদি আমরা হকার উচ্ছেদ করার মাধ্যমে আরো বেকার সৃষ্টি করি তাহলে নিঃসন্দেহে অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে।

এ পর্যন্ত দেশের যেসব শিল্প কারখানা বন্ধ করা হয়েছে আমরা কি সেইসব মানুষদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করতে পেরেছি? আদমজী জুট মিল বন্ধের প্রেক্ষিতে যে পরিমাণ মানুষ বেকার হয়েছে তাদের কতজনের কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে? যেখানে এত পরিমাণ বেকার সেখানে হকারদের ফুটপাত থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন করে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে বিকল্প বলে কিছু নেই। বিকল্পভাবে যদি সম্ভব হয় তাহলে এই মুহুর্তে যারা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশ জীবন যাপন করছেন তাদের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করা হলে দেশের উন্নয়ন তরান্বিত হবে। শুধুমাত্র জীবন ধারনের জন্যই তারা এই পেশাকে (হকার) অবলম্বন করে বেঁচে থাকছে। এই হচ্ছে তাদের জন্য বিকল্প। এই বিকল্প পেশাকে আরো সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ নতুন করে বেকারত্বের বোঝা বাড়িয়ে তুলবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপের পর অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। রিক্সা উচ্ছেদ, আদমজী পাটকল বন্ধ, বিভিন্ন কল কারখানা বন্ধ, গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ার ফলে প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। যার ফলাফল হিসেবে নাগরিক জীবনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। রাস্তায় হকার এটি বাস্তবতা। এই পেশায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা হয়েছে। এই পেশার মানুষদেরকে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি স্থায়ী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করা যেতে পারে।

চলাচলে নিরাপত্তা ও ফুটপাত
অনেক মহিলা যাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত বাইরে যাতায়াত করতে হয় তাদের মধ্যে বেশিরভাগের মতামত ফুটপাতে হকার থাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পাওয়া যায়। অন্যদিকে যে ফুটপাতে হকার নেই সেই রাস্তায় দিনের বেলায় চলাচলের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। ফুটপাতে মানুষের হেটে চলাচল করার জন্য হকারদের একটি ভূমিকা রয়েছে। যদিও হকারেরা জিনিসপত্র বিক্রির জন্য পুনরায় তাগিদ দিয়ে বিরক্তি উৎপাদন করে। আবার অনেক সময় হকারদের ভিড়ের কারণে ফুটপাতে চলাচলে স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়।

নিউমার্কেট এলাকায় নিয়মিত বাজার করেন এমন ব্যক্তিদের মতামত ফুটপাতে হকার থাকার অনেক সুবিধা রয়েছে। কলেজ ছাত্রী জয়া বলেন-‘‘ফুটপাতে হকার থাকায় কমদামে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস কিনতে পারা যায় এবং ফুটপাতে হকার থাকা জরুরি। কেননা এর সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।’’ ঢাকা শহরের কয়েকটি ফুটপাত ও ওভারব্রিজের দিকে লক্ষ্য করলেই এই তথ্যের যথার্থতা প্রমানিত হয়। যেসব ফুটপাত বা স্থানে কিছু কিনতে পারে বা লোকজন কোন কারণে অবস্থান করে শুধুমাত্র সেখানেই মানুষ চলাচল করে  থাকে। সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর ভবন, মৎস ভবন থেকে কলাবাগান বা মিন্টু রোডের ফুটপাতগুলো এ কারণে বেশিরভাগ সময় ফাঁকা থাকে।

আমার দুইবার ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে। প্রতিবার এমন জায়গায় হয়েছে যেখানে মানুষ কম, রাস্তায় হকার নেই। যে রাস্তায় হকার বেশি সেখানে ছিনতাই কম হয়। আমার পরিচিত যাদেরই ছিনতাই হয়েছে তাদেরও হয়েছে খালি রাস্তায়, যেখানে হকার ও মানুষ কম। হকার রাস্তায় থাকলে আমি চলাচলে নিরাপদ মনে করি। হকার হচ্ছে রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা রক্ষক। নাজনীন কবির

ঢাকা শহরের এমন অনেক ওভারব্রিজ রয়েছে যেখান দিয়ে খুব নগন্য পরিমাণ মানুষ যাতায়াত করে থাকে। যেসব ওভারব্রিজে হকার রয়েছে সেখানে বেশি মানুষ যাতায়াত করে থাকে। ফার্মগেট বা নিউমার্কেট ওভারব্রিজে প্রচুর হকার রয়েছে ও তুলনামূলকভাবে মানুষের চলাচলও অনেক বেশি। কিন্তু সাইন্স ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত ওভারব্রিজে খুব কম মানুষ যাতায়াত করে। এছাড়া শাহবাগে অবস্থিত ওভারব্রিজেও চলাচলকারী মানুষের সংখ্যা কম। কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরের এমন অনেক ওভারব্রিজ ছিল যেখান দিয়ে মানুষ কখনোই যাতায়াত করেনি। এসব ওভারব্রিজে ভবঘুরে বা নেশাখোরদের আড্ডা ছিল বিধায় মানুষ নিরাপত্তার অভাবে সে ওভারব্রিজ এড়িয়ে চলত।

বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটের সন্নিকটে অবস্থিত ওভারব্রিজটিরও একই চেহারা। এ ওভারব্রিজটি নান্দনিক হওয়া সত্বেও মানুষের চলাচল নেই। ফুটপাতগুলির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে। ফুটপাতগুলো শুধু পরিষ্কার হলেই চলবে না পাশাপাশি ফুটপাতে হকার থাকে মানে বিনামূল্যে নিরাপত্তাকর্মী সৃষ্টি এবং মানুষকে চলাচলে উৎসাহী করা।

‘‘কিছু কিছু ফুটপাতে হকার থাকার সমস্যা হলো কখনো কখনো চলাচলে বিঘœ ঘটায়। কিন্তু ফুটপাতে হকার থাকার সুবিধা অনেকগুলো। একটি বিশেষ সুবিধা হলো ফুটপাতে হকার থাকলে অনেকলোক যাতায়াত করে। এর ফলে মেয়েদের চলাচলের জন্য রাস্তা নিরাপদ হয়। যে সকল ফুটপাতে হকার নেই সেখানে লোকজন কম চলাচল করে। এজন্যে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের মতো অনেকেই ঐ পথ দিয়ে চলাচল করে  না।’’ নাজনীন কবির

সামাজিক নিরাপত্তায় হকারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান আইন শৃংখলার অবনতির পরিস্থিতিতে হকার ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তায় মানুষের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্য প্রয়োজন আমাদের জনশক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা। আমাদের জনশক্তিকে সমস্যা হিসেবে না দেখে সমাধান হিসেবে দেখলে রাষ্ট্র উপকৃত হবে।

মধ্যবিত্তদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সুলভ প্রপ্তিস্থান

ফুটপাত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ সহজে কেনাকাটা করতে পারছে। ফুটপাতে যারা ব্যবসা করে তাদের দোকান খরচ বা ডেকোরেশন খরচ নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে তারা তুলনামূলকভাবে অনেক কম দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে পারে। তাজা ফল ও সব্জি সুলভ মূল্যে পাওয়ার ক্ষেত্রে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের জুড়ি নেই। কাপড় বা অন্য অনেক সামগ্রী রয়েছে যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বড় দোকান হতে কেনা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তারা ফুটপাত ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে অনেক কম দামে কিনতে পারছে। ফুটপাতে অবস্থিত দোকানে ২০-৭০ টাকার মধ্যে ভাল শার্ট বা গেঞ্জি পাওয়া যায়। বড় দোকান থেকে সংগত কারণেই এত সস্তায় শার্ট বা গেঞ্জি কেনা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।

মধ্যবিত্ত শ্রেনীর জন্য ফুটপাতে হকার একটি আর্শিবাদ। ফুটপাত থেকে আমরা অনেক কিছুই স্বল্প দামে ক্রয় করতে পারি। জয়া, বয়স ২০,কলেজ ছাত্রী

হকারদের কল্যাণে রাস্তার পাশে বিভিন্ন জিনিস সহজে কিনতে পাওয়া যায় বিধায় অনেক লোক চলাচলের সময় তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার কাজটি সেরে ফেলতে পারেন। মতিঝিল, রাজস্ব ভবন এলাকার ফুটপাতে যারা বাজার করেন তাদের অধিকাংশ মানুষ আশপাশের অফিসে কাজ করেন। তারা অফিস ছুটির পর বাড়িতে যাওয়ার পথে বাজার করে বাসায় ফিরতে পারছেন।

স্বল্প আয়ের লোকদের খাবার প্রাপ্তিস্থান
ঢাকা শহরে ফুটপাতে অবস্থিত খাবার দোকানে স্বল্প আয়ের মানুষ যেরকম অল্প টাকায় খেতে পারে তা অন্য কোন স্থানে সম্ভব নয়। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ফুটপাতে ভাত, রুটি, বিরানী, পিঠা, ঝালমুড়ি, বিভিন্ন ফল ও সব্জির দোকান রয়েছে।

ঢাকায় অবস্থানকারী অধিকাংশ দরিদ্র পেশার মানুষ এই দোকান থেকে খাবার খায়। অনেকেই রাস্তার আশ-পাশের দোকানের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু যারা খাচ্ছে তাদের মতে, এইসব দোকানের খাবারের মান ভালো, আমাদের খেতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। এছাড়া সম্প্রতি সময়ে পরিচালিত ভেজাল বিরোধী অভিযানের প্রেক্ষিতে দেশের আভিজাত দোকানোর খাবাবের মান নিয়েও আমরা অনেকেই শংকিত। সেখানে ফুটপাথের দোকানের খাবারের মান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তাদের উচ্ছেদের যুক্তি অবান্তর।

রিকসা/ভ্যান চালকদের অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় তারা এই দোকানের খদ্দের। ফুটপাতে অল্প দামে খাবার পাওয়ার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই বিষয়টিকে কোন ভাবেই অবজ্ঞা করা যায় না। ফুটপাতের দোকান তুলে দিলে এই দরিদ্র লোকদের খাবারের সঙ্কট তৈরি হবে। ফুটপাথের এই ব্যবসার উপর নির্ভর করে অনেক পরিবার টিকে রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও চিন্তা করা উচিত।

অনেক স্থানে দেখা যায় রাস্তার পাশে বসে সব্জি বিক্রি করা হয় । বাজারের তুলনায় যে সকল সব্জি বিক্রেতা রাস্তার পাশে বসে সব্জি বিক্রি করে, কিনতে গেলে তাদের কাছে বাজারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়। কষ্ট করে বাজার পর্যন্ত যেতেও হয়না।

নীলক্ষেত এলাকায় অনেক খাবার দোকান রয়েছে। যাদের জায়গার সংকুলন না হওয়ায় তারা ফূটপাতের কিছুটা অংশ ব্যবহার করে থাকে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়/ বুয়েট/ইডেন কলেজ/ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ/ঢাকা কলেজসহ অত্র এলাকার ছাত্রছাত্রীদের খাবারের চাহিদা মেটায়। এখানে প্রতিদিন সস্তায় অনেক ছাত্রছাত্রী খাবার খেয়ে থাকে। এসব দোকান উচ্ছেদের পূর্বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের খাবার প্রাপ্তির বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিৎ।

ফুটপাত ও বিনোদন
শাহবাগ, টিএসসি, নাটক সরণি, সংসদ ভবন এলাকায় অনেক ভ্রাম্যমান খাবারের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, চা বিক্রি করছে। এ দোকান ঘিরে গড়ে উঠছে মানুষের আড্ডা বা বিনোদনের স্থল। যেখানে সস্তায়
খাবারের নিশ্চয়তার সাথে সাথে বিনোদন ও মানুষের মিলনমেলা গড়ে উঠেছে। জাদুঘর ও পাবলিক লাইব্রেরী এলাকায় খাবারের ভাল কোন দোকান নেই, এখানে মানুষের বিনোদনের পাশাপাশি খাবারের উৎস হচ্ছে ফুটপাতের দোকান। এছাড়া ফুটপাতে খুবই অল্প দামে বিভিন্ন ধরনের খেলনা পাওয়া যায়।

ফুটপাতে প্রচুর টাকা লেনদেন হচ্ছে
ঢাকা শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাজ সজ্জার জন্য সতেজ ফুলের জুড়ি নেই। এর যোগান আসে শাহবাগ ফুটপাতে অবস্থিত ফুলের বাজার হতে। শাহবাগ এলাকার ফুটপাতে প্রায় ৩০-৩২ টি ফুলের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন প্রতিটি দোকানে গড়ে ৩০০০-৫০০০ টাকার বিক্রি হয় এবং গড়ে ৩০ শতাংশ লাভ করে থাকে। প্রতি দোকানে কাজ করছে ৫-৯ জন। যেখানে মহিলাদের একটি বড় অংশ রয়েছে।

ফুটপাত, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প ও নার্সারি
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কিংবা হাতের তৈরি জিনিস পত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের ফুটপাতগুলো একটি অনন্য ভূমিকা পালণ করে আসছে। দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ তাদের এসব তৈরি জিনিস বিক্রয় করতে সহজে। দেশের সাধারণ মানুষও স্বল্প দামে ক্রয় করতে পারে। দোয়েল চত্বরে শিশু একাডেমীর সামনের প্রায় ৩০টি দোকান আছে। যেখানে বিক্রয় করা হয় বিভিন্ন মাটির ও হাতের তৈরি জিনিসপত্র। এখানকার একটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক হচ্ছে  এ দোকানগুলো ফুটপাতের এক পাশে সবচেয়ে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত অবস্থায় অবস্থিত।

হকাররা মানুষকে ফুটপাত ব্যবহারে উৎসাহী করেছে
আমি নীলক্ষেত্র এলাকায় আসলে  হাটি। এক এখানের ফুটপাথে অনেক সময় কম দামে অনেক পুরাতন বই পাওয়া যায়। অনেক দূর্লভ পুরাতন বইও আমি এখান হতে পেয়ে থাকি। আর ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাথে অনেক সময় ভাল গাছের চারা পাওয়া । সেই লোভের এই ফুটপাথ ধরে হেটে থাকি। সবসময় কিনি তা নয় তবে হাটতে ভাল লাগে। রাজিব

মানুষ সবসময় কিছু না কিছু দেখতে চায়, সেক্ষেত্রে রাস্তায় কিছু না থাকলে চলাচল করতে উৎসাহ পাবে না। ঢাকার বেশ কয়েকটি রাস্তায় হকার না থাকায় মানুষের চলাচল অপেক্ষাকৃত কম। হকার রাস্তায় থাকায় মানুষ জিনিস দেখতে বা ক্রয় করার উদ্দেশ্যে হেটে চলাচল করে।  মানুষ নিরাপত্তা ও ক্রয় সুবিধার জন্য ফুটপাতে চলাচল করে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে এলাকায় হকার রয়েছে সেখানে লোকজনের চলাচল বেশি।

রিক্সা বন্ধ ও ফুটপাতের উপর প্রভাব
অপরিকল্পিত পদক্ষেপ আমাদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে তার প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে রিক্সা উচ্ছেদ। রিক্সা উচেছদ করার পাশাপাশি শুধু সাধারণ মধ্যবিত্ত জনগণের চলাচলের অসুবিধা হয়েছে তা নয়। তার প্রভাবে ফেলেছে বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের জীবন যাপনের উপর। বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাস্তা থেকে রিক্সা ও অযান্ত্রিক যানবাহন বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গত ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে গাবতলী থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত সড়কটিতে রিক্সাসহ সকল প্রকার অযান্ত্রিক যানবাহন চালাচল বন্ধ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৭ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে রাসেল স্কোয়ার থেকে আজিপুর পর্যন্ত রাস্তায় অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড (ডিটিসিবি) কর্তৃক গাবতলী থেকে রাসেল স্কোয়ার পর্যন্ত রিক্সাসহ অন্যান্য অযান্ত্রিক যানবাহন উচ্ছেদ করার প্রেক্ষিতে এই সড়কে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে সেটি জানার জন্য হিউম্যান ডেভলেপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি) একটি অনুসন্ধানমূলক গবেষণা ও প্রতিবেদন তৈরি করে। এ গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, রিক্সা বন্ধের প্রেক্ষিতে শুধু রিক্সা চালক বা রিক্সা ব্যবহারকারীদের সমস্যা হচ্ছে তা নয়। এর পাশাপাশি রাস্তার পাশের দোকানগুলো বিশেষ করে হকার পেশায় নিয়োজিতরা ভীষন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাস্তার পাশের হকারদের একটি বড় অংশের ক্রেতা হচ্ছে যারা রিক্সায় চলাচল করে। রিক্সায় চালাচলের সময় যাত্রীরা অনেক সময় হকারদের নিকট থেকে কেনা কাটা করে। নাসরীন খন্দকার ও জনথন রোজ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, রিক্সা বন্ধের প্রেক্ষিতে হকারদের মধ্যে যারা রাস্তায় কাপড় বিক্রি করে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। হকার পেশায় যুক্ত মামুন নামের একজন অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, রিক্সা বন্ধের পুর্বে এই রাস্তায় অন্তত ২৫ জন হকার ছিল, কিন্তু বর্তমানে বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেকেই এই পেশা ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের মূল ক্রেতা হচ্ছে রিক্সাওয়ালা ও রিক্সায় যারা চলাচল করে, যার ফলে রিক্সা উচ্ছেদের প্রেক্ষিতে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হবার উপক্রম। তাছাড়া পরিবারের চাহিদা মেটাতে এখন আগের তুলনায় আমাদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে হচ্ছে। ফরিদ নামক এক হকার জানালেন, আমি বর্তমানে ৭ পিস মুরগি বিক্রি করতে পারি আগে যেখানে ১০০ পিস বিক্রি করতে পারতাম।

রিক্সা উচ্ছেদের ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে উক্ত সড়কের পাশে অবস্থানরত রিক্সা মেরামতকারী পেশাজীবিদের উপর। বেশিরভাগ রিক্সা মেকানিক পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে, কেউ কেউ নতুন পেশা গ্রহণ করেছে, আবার অনেকে নতুন কোন অবস্থান খুঁজে নিতে চেষ্টা করছে।

রিক্সাচালকরা হকার পেশায় নামতে চায়
হিউম্যান ডেভলেপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি) এর অনুসন্ধানমূলক গবেষণা ও প্রতিবেদনে যদিও সুপারিশ করা হয়েছে আগে যারা অযান্ত্রিক যানবাহন চালাতো তারা এখন যান্ত্রিক যানবাহন চালানো শিখবে। কিন্তু রিক্সাচালকদের মধ্যে ১.৬% যান্ত্রিক যানবাহন চালাতে চায়। ৫৫.৯% অন্য বিকল্প কিছু করতে চায়, ৬% যান্ত্রিক যানবাহনের হেলপার বা সুপারভাইজার হতে চায়,  ২৭% কৃষি কাজে ফিরে যেতে চায়, ২৩% শ্রমিকের কাজ করতে চায় এবং কিন্তু ৩৬% চায় তারা কোন হকারের কাজ করবে।

অনেকেই ফুটপাতে ব্যবসার পরিবর্তে বিকল্প কিছু করতে চায়। উল্লেখিত প্রতিবেদন ও গবেষণা রিপোর্টে ৫৫.৯% বিকল্প কিছু করার কথা ভাবছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিকল্প কি সে সম্পর্কে সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের জনসংখ্যা, সম্পদ, ভূমি মোটকথা বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থান এর বিষয়টি ভাবতে হবে। আর কোন সুযোগ না থাকায় এই বিপুল জনগোষ্ঠী কাজের সন্ধানে ঢাকা শহরে এসেছে এবং অর্থনীতি ও সামাজিক অবকাঠামোর একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকল্প বা উচ্ছেদ অভিযান কোন সমাধান হতে পারে না, প্রয়োজন সুশৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে এদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া।

প্রয়োজন পেশার স্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদা
সেই প্রাচীন কাল থেকে কৃষক এ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আমরা কখনো তাদের যথাযথ মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি দেইনি। আমরা অনেকেই গালি হিসেবে চাষাভূষা শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু একটি বিষয় আমরা কখনো বিবেচনা করি না তারা যে জ্ঞান আর প্রজ্ঞা ব্যবহার করে  ফসলের চাষ করছে আমাদের ক‘জনের পক্ষে সে কাজ করা সম্ভব? রফিকুল ইসলাম মিলন, উন্নয়নকর্মী

শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে তাত্ত্বিকভাবে মর্যাদা দেয়ার কথা বললেও সেটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। গবেষণার কাজে যেসব ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে- দেখা গেছে তাদের অনেকেই নিজ পেশার জন্য হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের নিজের পেশার প্রতি আস্থা বা শ্রদ্ধাবোধ নেই। অনেকেই নিজের পেশা ছেড়ে দিতে চায় যদিও তাদের আয় তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। তারা চায় আরো ভালো ব্যবসা করতে। কিন্তু সেই ব্যবসার আয় কতটুকু হবে সে সম্পর্কে  তাদের অনেকেরই ধারণা নেই।

ক্রেতাদের অশালীন ব্যবহার, অবজ্ঞা, নীচু হিসেবে দেখার কারণে হকার পেশায় নিয়োজিত মানুষদের মধ্যে হীনমন্যতার সৃষ্টি করে। তাছাড়া এ পেশার কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় তাদের অবস্থা কোথায় তারা জানেন না। অনিশ্চিত জীবনের জন্য তারা সবসময় হতাশায় ভোগে। এদের বেশিরভাগের উচ্চারণ-গরীব মানুষ, কি করবো, কিছু করার নেই, আমাদের আবার জীবন, কোন রকমে বাইচ্চা আছি। অনেক হকার আছে যাদের আয় ৩০০০-১০,০০০ টাকার মধ্যে কিন্তু তাদের ভাবনাও একইরকম। অথচ সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করে অন্য কোন পেশার চাকরিজীবি তাদের থেকে ভাল অবস্থানে রয়েছে। শুধুমাত্র সামাজিক স্বীকৃতি নেই বলেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্বেও হকার পেশার মানুষেরা নিজেদের হেয় ভাবছে।

একজন হকারের উক্তি-মানুষ কুকুর বিলাইয়ের মতো ব্যবহার করে ভাই,
এই জীবনডা ভাল লাগে না।

প্রায় ৭ বছর ধরে এরশাদ ফুটপাতে চা বিক্রি করে। সে এ কাজ ছাড়তে চায় কারণ জানতে চাইলে তিনি জানালেন-অনেক কম বয়সী ছেলেরা তার সাথে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করে এবং অধিকাংশ লোকজন তাকে তুই বলে সম্বোধন করে। যা আয় করছে তা নিয়ে তার যতটুকু না আপত্তি তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ মানুষের আচরনের জন্য।

গাড়ি পার্কিং ও হকার
ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ির ক্রমবৃদ্ধি উদ্বেগের বড় কারণ। ঢাকায় অনেক রাস্তায় রিক্সা বন্ধ করা হলেও সেসব স্থানে জ্যাম লেগেই রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন নতুন নতুন মডেলের প্রাইভেট গাড়ি নামছে। যাত্রী পরিবহনের অনুপাতে
অনেক বেশি জায়গা নিয়ে প্রাইভেট গাড়ি সৃষ্টি করছে যানজটসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। পরিবেশ ও যানজটের কথা বাদ দিলেও প্রাইভেট গাড়ির অন্যতম বড় সমস্যা পার্কিং।

প্রাইভেট গাড়ি দেশের উন্নয়ন বা অর্থনীতিতে কোন ধরনের ভূমিকা রাখছে কি? হিসেব করলে দেখা যাবে গাড়ির জন্য দেশের কোটি কোটি টাকা বাইরের দেশে চলে যাচ্ছে। এছাড়া সৃষ্টি করছে পরিবেশ দুষণ ও যানজট। তথাপি প্রাইভেট গাড়ির জন্য জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালায় পার্কিং পলিসি গ্রহনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা শহরে গড়ে উঠছে অত্যাধুনিক গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। কিন্তু জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালার কোথাও উল্লেখ করা হয়নি দরিদ্র হকার বা ফুটপাত ব্যবসায়ীদের জন্য কোন কার্যক্রম বা পরিকল্পনার কথা। যদিও এ পেশায় কর্মরত একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা রাখছে।

হকার ও  আন্তজার্তিক কার্যক্রম
হকারদের অধিকার রক্ষায় ১৭ মার্চ ২০০৪ সালে এক সম্মেলনের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঝঃৎববঃঘবঃ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ নামে একটি বেসরকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলা হয়। কোরিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ এ সংস্থার সদস্য। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে এ সংস্থার কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ভারত, কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিমধ্যে এসব ভেন্ডারদের অধিকার রক্ষায় ও সুশৃঙ্খল আনয়নে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন  করেছে।

হকার নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ হকারদের অভিমত
হকারদের অবস্থাও কার্যক্রম নিয়ে হকার্স নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে হকারদের পূর্ণবাসনের দাবি জানিয়ে আসলেও কোন সরকারই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ঢাকার হকাররা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। প্রতিটি হকারকে এলাকা অনুসারে ২০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। হকারদের উন্নয়নে হর্কাস মার্কেট করা হলেও তাদের অভিযোগ হকার্স মার্কেট থেকে সাধারণ হকাররা কোন লাভই পাচ্ছে না। কোন সাধারণ হকারের পক্ষে এত টাকা দিয়ে দোকান কেনা সম্ভব নয়।

হকার্স নেতারা জানান, তাদের দাবি নিয়ে তারা একাধিকবার বিভিন্ন মন্ত্রী, সিটি কর্পোরেশনের সাথে আলোচনায় মিলিত হয়েছেন। কিন্ত সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্যযোগ্য- হকার্স নেতাও তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কোন সূচিন্তিত ও পরিকল্পিত সমাধান দিতে পারেনি। পুর্ণবাসনের নামে তারা যে সমাধানের কথা বলছে তা কোন কোন ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য। কেননা কোন কোন নেতা হকার্স মাকের্টের বিরোধীতা করলেও কোন কোন নেতা হকার্স মাকের্ট তৈরি মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করছেন। তবে তারা কিছু যৌক্তিক দাবিরও অবতারণা করছে, যেমন তারা হর্কাসদের জন্য সিটি কর্পোরেশন হতে ট্রেড লাইসেন্স তৈরির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। নেতৃবৃন্দের মতো হকারদের তালিকা তৈরি তাদের কাজ হতে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে তাদের পূর্ণবাসনের কাজ করা সম্ভব।
হকারদের পুনবার্সন করার লক্ষ্যে নেতৃবৃন্দের প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে
ক্স হকার্স মার্কেট নির্মাণ
ক্স হকার্সদের ঋণ প্রদান ও গ্রামে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি
ক্স কিছু কিছু হকারকে কুটির শিল্প ও পোলটি ফার্ম বা কলকারখানা করে পূর্ণবাসন
ক্স হকারদের প্রশিক্ষন দিয়ে বিদেশে প্রেরণ
ক্স ঢাকার বাইরে হকার্স পল্লী গঠন

প্রকৃতি অনুসারে হকারদের ২ ভাগে ভাগ করা যায়। মৌসুমী হকার এবং স্থায়ী হকার। মৌসুমী হকার হচ্ছে যাদের নিজ এলাকায় কর্মস্ংস্থান আছে কিন্তু তারা অতিরিক্ত আয়ের জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে শহরের এসে ব্যবসা করে থাকে। তারা কোন সংগঠনের সদস্য নয়, তারা যে কোন উপায়ে পুলিশ বা মস্তানদের ম্যানেজ করে ব্যবস্থা করে। হকার নেতাদের অভিযোগ এ সকল হকাররা বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করে থাকে। কারণ তাদের কোন নিয়ম নীতি সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা কোন সংগঠনের সদস্য নয় বা কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় নেতৃবৃন্দের মতে এদের উচ্ছেদ করলে ঢাকার হকার অর্ধেক কমে যাবে।

স্থায়ী হকার হচ্ছে যারা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা করছে। তারা কোন না কোন সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নেতৃবৃন্দের প্রতি সাধারণ হকারদের রয়েছে প্রচুর অভিযোগ। তাদের অনেকেই অভিযোগ করে- নেতারা তাদের দেখছে না বা তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে নেতাদের কাছে যাওয়া যায় না। মাস্তান ও পুলিশকে তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। তাদের কোন ধরনের ভবিষ্যত নেই। কোন স্থায়ী কাঠামো করার অবস্থা নেই বলে তাদের রোদ ও বৃষ্টিতে সমস্যা হয়। কখনো কখনো পুলিশ তাদের অবকাঠামো ভেঙ্গে দেয়। বিগত সময়ে অনেকেই তাদের আশা দিয়েছে কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান হয় নি।


বর্তমান আইন ও নীতির বিশ্লেষণ: ফুটপাত নীতিমালা ও করণীয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০০৪সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। উক্ত নীতিমালার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে ‘‘‘জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবহনের উপযুক্ত ভৌত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নিশ্চিত করার জন্য স্থল পরিবহন নীতিমালা অপরিহার্য। জীবিকার অন্বেষনে বাংলাদেশের মানুষকে সীমিত জীবনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয় যাতায়াত ও পরিবহনে। সুতরাং একটি নিরাপদ, সুলভ, যুগোপযোগী, প্রযুক্তিগতভাবে নির্ভরশীল, পরিবেশ বান্ধব এবং বিশ্বায়নের আলোকে প্রণীত হয়েছে জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালা।’’ এই নীতিমালার ১৪নং উদ্দেশ্যে দারিদ্র বিমোচন এবং নিম্ন আয়ের গোষ্ঠী যাতে উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারে সে লক্ষ্যে সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সঙ্গে পরিবহন খাতকে সম্পৃক্ত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নীতিমালার প্রস্তাবনা ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষনের আলোকে এই বিষয়টি অবশ্যই পরিস্কার বুঝা যায় সরকারের উদ্দেশ্য একটি নিরাপদ, পরিবেশ বান্ধব, যুগোপযোগী এবং দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আর সেক্ষেত্রে রাস্তার পাশের হকারদের অবস্থান কিভাবে নির্ধারিত হবে তা ভেবে দেখতে হবে।

নীতিমালার ৫.৭ ধারায় হাটবাজারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইনী পদক্ষেপ গ্রহনের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালায় সড়কের পার্শ্ব ব্যবস্থাপনায় কথা বলা হয়েছে এবং উক্ত পার্শ্ব ব্যবস্থাপনায় মাছ চাষের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে হকার বা ছোট ছোট দোকানীদের বিষয়ে করণীয় কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে নীতিমালা ৫.৮.১-এ হাটবাজারের প্রয়োজনীয়তা অন্তর্ভূক্ত করে সড়ক নির্মাণের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে হকারদের জন্য কিছু করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

৭.২ পথচারীদের জন্য উন্নততর পরিবেশ সৃষ্টি
নীতিমালায় শহর এলাকায় অধিক সংখ্যক পায়ে চলার পথ নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে এবং পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তার লক্ষ্যে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, শিশুদের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালার এই ধারা অনুসারে পথচারীদেরকে পায়ে হেটে চলাচলে উৎসাহী করতে ফুটপাতে হকার থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে ফুটপাতে হকারদের জন্য পরিমিত পরিমাণ জায়গা বরাদ্দের মাধ্যমে সষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা সম্ভব।

উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো অলোচনার প্রেক্ষিতে একটি বিষয় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় হকার ফুটপাতের একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালার স্থল ব্যবস্থাপনা ও রাস্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা হলেও হকারদের নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। সরকারের নীতিমালায় হকারদের নিয়ে আলোচনা না হওয়ার প্রেক্ষিতে তা হকারদের উন্নয়ন ও তাদের বিষয়ে যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহনের অন্তরায়।

রাস্তা ও ফুটপাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা
আইনী জটিলতা
জনসাধারণকে ফুটপাত ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হকারের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ঢাকা শহরের ফুটপাতে বিপুল সংখ্যক হকার ব্যবস্থা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। পাশাপাশি এ বিষয়টিও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই অনেক এলাকায় হকারদের কারণে রাজপথে চলাচল ব্যহত হচেছ। প্রচলিত আইন অনুসারে রাজপথে হকারদের এ ধরনের ব্যবসা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনী ক্ষমতা বলে এ ধরনের কার্যক্রম করার ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা হকারদের স্থাপনার অপসারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া মহামান্য হাইকোর্ট জনস্বার্থে ২০০১ সালে একটি মেয়র, আইজিপি, পূর্ত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি নির্দেশ দেন যে, সড়ক ও ফুটপাত হকার ও নির্মাণ সামগ্রী হইতে মুক্ত রাখিতে হইবে। পাশাপাশি আদালত কর্তৃপক্ষকে এই নির্দেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সংক্রান্ত তথ্য প্রতি তিনমাস অন্তর হাইকোর্টের রেজিষ্টার বরাবরে দাখিলের নির্দেশ প্রদান করে। উল্লেখ্য যে, হকার্স সমিতি হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছে যা বর্তমানে বিচারাধীন আছে।  হকারদের উন্নয়নে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে আইনী এ সকল বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। নয়তো আইনী জটিলতা বা সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

হকারদের সঠিক ও সুষ্ঠু পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন হকারদের অধিকার সংরক্ষন এবং সরকারী সংস্থাগুলোর মাঝে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই হকারদের ওহভড়ৎসধষ ঞৎধফরহম এৎড়ঁঢ় হিসেবে চিহ্নিত করে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও জাতীয় অর্থনীতিতে হকারদের অবদান ও গুরুত্ব স্বীকার করে।

হকারদের উন্নয়নে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন
স্বল্প মেয়াদী কার্যক্রম:
* হকারদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্বল্প টাকায় লাইসেন্স প্রদান করা।
* সরকার, বেসরকারী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও হকারদের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠণ এবং ঢাকার রাস্তার পার্শ্বের বিভিন্ন খালি জায়গাগুলো চি‎িহত করা ও হকারদের বসার ব্যবস্থা করা।
* অনেক হকার আছে খুবই অল্প জায়গা নিয়ে ফুটপাতে বসে (যেমন- ছোট ফল, ফুল, সবজি ইত্যাদি বিক্রেতাদের) লাইসেন্স সাপেক্ষে ফুটপাতের পাশে বসার ব্যবস্থা করা করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়দীয় কার্যক্রম:
* হকারদের পেশার স্বীকৃতি প্রদান।
* হকারদের বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সাধারণ হকারদের সাথে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
* হকারের উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের উপর ন্যস্ত করা।
* হকাররা শহরের কোথায় কোথায় ব্যবসা করতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম
* শহর এলাকায় হকারদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রদান করে আইন/নীতি গ্রহণ।
* রাস্তা বা ফুটপাত তৈরির  ক্ষেত্রে হকারদের বসার ব্যবস্থা রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ।
* হকার উচ্ছেদের সহায়ক প্রচলিত আইনের সংস্কার
* শহরের উন্নয়ন বা সংস্কারের পরিকল্পনা গ্রহন যাতে হকাররা রাস্তার পাশে ব্যবসা করতে পারে।
* হকারদের ব্যবসা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান।
* হকারের ব্যবসার বৃদ্ধিতে কারিগরী ও আর্থিক সহযোগিতা।
* দূর্যোগ বা দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে হকারদের সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা তৈরি।
* শহরের হকারদের উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রেনীর প্রতিনিধিদের (সরকারী সংস্থা, হকারদের নিয়ে কার্যরত বেসরকারী সংগঠন, ব্যাংক কোম্পানির প্রতিনিধি, স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিধি, রেজিষ্টার্ড হকার সমিতিরি প্রতিনিধি) সমন্বয়ে কমিটি গঠন।
* রেজিষ্টার্ড হকার সমিতি বা কমিটির গঠনে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান।
* আইন অনুসারে সদস্যপদ প্রদানকৃত এবং আর্থিক হিসাব স্বচ্ছ এ ধরনের হকার সংগঠনকে নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে অগ্রাধিকার প্রদান।
* অবৈধ চাঁদা প্রদানের হাত হতে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
* বড় মার্কেটগুলোতে হকারদের বাসার জন্য জায়গা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।

হকারা এ দেশের মানুষ। জীবনের তাগিদে নিরূপায় হয়ে তাদের রাস্তায় নামতে হয়। বর্তমানে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অন্য কোন বিকল্প কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করাও কঠিন বিষয়। কেননা ইতিমধ্যে আমাদের উপর রয়েছে বিশাল বেকার জনগোষ্ঠির বোঝা। তাছাড়া সার্বিক বিবেচনায় হকাররা ফুটপাতে থেকে সামাজ ও রাষ্ট্রের অনেক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। তাই তাদের উচ্ছেদ না করে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ সুযোগ সৃষ্টি হবে উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের একটি প্রকৃত উদাহরণ।