হারালেন পা, হলো ফুটওভার ব্রিজ
নিখিল ভদ্র একটি উদাহরণ মাত্র। বৃদ্ধ, অসুস্থ্য রোগী, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু, ক্লান্ত পথিক, মালামালবহনকারী বা অর্থাইটিসে আক্রান্ত মানুষের পক্ষে এই পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হয় না বিধায়, অধিকাংশ ব্যক্তিই জীবনের ঝুকি নিয়ে নিচ দিয়ে পথ পারাপার হয়। নগর যাতায়াত ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো উদাসীনতার কারণে ঢাকা শহরের প্রতিদিন একজন করে পথচারী দুঘর্টনায় আহত বা নিহত হয়। ঢাকা শহরের সংঘটিত সড়ক দূঘর্টনার প্রায় ৮৬% শিকার পথচারী।

পথচারীদের প্রতি নির্যাতনমূলক এই ধরনের কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে পথচারীদের অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলো বিবেচনা করা উচিত। পথচারীদের জন্য সিটি কর্পোরেশন আইন, মোটরযান আইন ১৯৮৩ এবং মেট্রোপলিটন আইনে বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু এ বিধানগুলো গাড়ী চালকরা মান্য করে না, অনেকেই এই আইন সম্পর্কে জানে না। ট্রাফিক বিভাগের লোকবলের সীমাবদ্ধতার কারণে পথচারীদের নিরাপত্তায় এই আইনের প্রয়োগ খুবই সীমিত। নগরে পথচারীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কর্পোরেশনের আইনের তফসিল ১৯.১ এ বলা রয়েছে, পথচারী যাহাতে পথ চলিতে বিপদগ্রস্ত না হন এবং তাহার নিরাপদ ও অনায়াসে পথে চলাফেরা করিতে পারে সেই জন্য কর্পোরেশন প্রবিধান দ্বারা যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মোটর যান আইনের ধারা ১৬৪ তে বলা হয়েছে পথচারী পারাপারের নির্ধারিত স্থানে কিংবা ঠিক সন্নিকট দিয়ে কিংবা যেখানে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এসব স্থানে ওভারটেক করলে ড্রাইভিং লাইসেন্স হতে বঞ্চিতকরণ করা যাবে। কিন্তু এ আইনের আজ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়নি। ঢাকা বিদ্যমান পরিবহননীতি এসটিপিতে পথচারী অগ্রাধিকার নীতি বিষয়ে বলা হলেও বর্তমান অবস্থায় অগ্রাধিকার অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়।
মহামান্য হাইকোর্ট গত ৭ মার্চ ২০১২ তারিখে পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলানো বন্ধসহ কতিপয় নির্দেশনা প্রদান করে। আদালতের নির্দেশনার পরবর্তীতে ঢাকা বিভিন্ন স্থানে জেব্রা ক্রসিং অংকন করা হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে অংকিত এ সকল জেব্রা ক্রসিংগুলো রয়েছে নানা সমস্যা। জেব্রা ক্রসিং থাকলেও অনেক স্থানেই পারাপারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, কোন জেব্রা ক্রসিং এর শুরু অথবা শেষে গর্ত বা ড্রেন রয়েছে, ক্রসিংগুলো উচু নিচু অর্থাৎ সমান্তরাল নয়, জেব্রা ক্রসিং এ অসম্পুর্ণ রেইজ ওয়াকওয়ে (উচু হাঁটাপথ), যা শুধুমাত্র শাহবাগ রয়েছে এবং অনেক স্থানে জেব্রা ক্রসিং এর পূর্বে গাড়ী থামানোর জন্য দাগ নেই।
এছাড়া অধিকাংশ স্থানেই জেব্রা ক্রসিং অনেক দুরুত্বে, যা সর্বোচ্চ ২০০ মিটার এর মধ্যে থাকা প্রয়োজন, জনবহুল স্থান এ স্বচ্ছন্দে পারাপার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং নেই এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও ইন্টার সেকশনে জেব্রা ক্রসিং নেই। জেব্রা ক্রসিংগুলিতে সিগন্যাল বাতি এবং সাইন নেই, অনেক স্থানে সাইন আছে, কিন্তু জেব্রা ক্রসিং মুজে গেছে, অনেক স্থানে সিগন্যাল বাতি আছে, কিন্তু কাজ করে না। পথচারীদের পারাপারের জন্য কোন ধরনের সিগ্যন্যাল নেই।
ঢাকা শহরের পথচারীদের নিরাপদ পারাপারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা গাড়ী। গাড়ীগুলো পথচারীদের পথ চলার অধিকারকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত করছে। গাড়ী চালকরা জেব্রা ক্রসিং দখল করে দাড়িয়ে থাকে, কোন চালকরাই জ্রেবা ক্রসিং-র পূর্বে দাগ মানছে না, প্রতিনিয়ত পথচারীদের অধিকার লঙ্গন করলেও গাড়ী চালকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বাস, মিনিবাসগুলো বেপরোয়া চালনার প্রতিয়িত আতঙ্কিত করে পথচারীদের। এছাড়া ধানমন্ডি, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যা নামতেই চলে উচ্চশব্দের ব্যবহারের পাশাপাশি গাড়ীর বেপরোয়া গতি প্রতিযোগিতা। আর এ প্রতিযোগিতার কারণে আতংকিত, কখনো কখনো দূঘর্টনার শিকার হয় পথচারী।
ঢাকা শহরের ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য অভিযোগ বরাবর হকারদের দিকেই থাকে। অথচ ঢাকা শহরের কয়েকটি স্থান ব্যতীত অধিকাংশ স্থানের ফুটপাত দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ী, হুডা, দোকানো মালপত্র বা সাইন বোর্ড। এছাড়া কোথাও কোথাও ফুটপাতগুলো ভেঙ্গে দোকান ও বাড়ীতে গাড়ী প্রবেশের জন্য নিজেদের মতো রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যা পথচারীদের নিরাপদ চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
ফুটপাতে হকারদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও। ফুটপাত ভেঙ্গে গাড়ী প্রবেশের ব্যবস্থা করার প্রেক্ষিতে মার্কেট বা বাড়ীর মালিকদের উপর কোন ধরনের আইন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফুটপাত ভাঙ্গার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি হকারদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফুটপাতের পাশে বসার ব্যবস্থা করা জরুরি। ফুটপাতগুলোর কোনটাই বৃদ্ধ, অসুস্থ্য রোগী, প্রতিবন্ধী, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী নয়। অধিকাংশ ফুটপাতগুলো খাড়াভাবে নেমে গেছে। এছাড়া ভাঙ্গা ফুটপাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলের সমস্যাতো বরাবরই রয়েছে।
গাড়ীর কারণে পথচারীরা আহত বা নিহত হলেও পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য জেব্রা ক্রসিং, সাইনের মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, সড়ক পারাপারের জন্য মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে। ক্লান্ত পথিক, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য রোগী, মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধীদের পক্ষে ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব না হলেও, জোরপূর্বক ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের বাধ্য করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ীর সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করা বা বাধ্য করা বাংলাদেশ সংবিধানের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অনুচ্ছেদ-১১, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি অনুচ্ছেদ ১৪, সুযোগের সমতা অনুচ্ছেদ-১৯ (১) (২), আইনের দৃষ্টিতে সমতা অনুচ্ছেদ-২৭, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ অনুচ্ছেদ ৩৪ (১), চলাফেরার স্বাধীনতা অনুচ্ছেদ-৩৬ এর পরিপন্থী।
এই শহরে ধনী-গরীব সকলকেই কিছুটা সময় হাটতে হয়। ধনীরা হয়তো পার্কে হাটেন স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষকে হাটতে হয় নিত্য দিনের প্রয়োজনে। এ পর্যন্ত যতজন যোগাযোগ মন্ত্রী এসেছেন তারা প্রকৃত পক্ষে সবাই প্রাইভ্টে গাড়ী কিভাবে যাবে তাই নিয়ে পরিকল্পনায় ব্যস্ত, যার ব্যবহারকারী এই নগরে ৫% মানুষ। বাকী ৯৫ ভাগ মানুষ চলাচল করে হেটে, বাসে, সাইকেলে রিকশায়। জেব্রা ক্রসিং, প্রশস্ত ছায়াময় ফুটপাত, নিরাপদ সাইকেলে যাতায়াত, রিকশার জন্য পৃথক লেন, প্রতি রুটে বাস এবং পরিবহন ভাড়া নিয়ন্ত্রণ এই ৯৫ ভাগ মানুষের জীবনের সাথে জড়িত। যা বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন, সম্পদের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র আইনী প্রয়োগ ও বিদ্যমান সম্পদের ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর এ বিষয়ে উদাসীনতা সুপষ্ট বিদ্যমান। যানজটের নামে লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প বান্ধব আলোচনা, পরিকল্পনা আর কার্যক্রম নগর পরিকল্পনার প্রাণ।
প্রতিদিন ৯৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া সন্ত্রাস, নিরাপদ যাতায়াতের সমস্যায় ভুগছে আর আমাদের যোগাযোগ সংশ্লিস্ট বিভাগুলো শুধু ব্যস্ত যানজট সংক্রান্ত প্রকল্প বান্ধব কার্যক্রম নিয়ে। যানজট ছাড়াও যে অন্য বিষয় আছে তা তাদের ভাবতে হবে। যে সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন নেই। পথচারীরা যানজট সৃষ্টি করে না, পরিবেশ দুষণ করে না। পথচারীদের জন্য উন্নত পরিবেশ মানে অসংক্রান্ত রোগ নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের উদ্যোগও বটে। শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ, ফুটপাত ও জেব্রা ক্রসিং সংস্কার, গাড়ীচালকদের নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক স্বল্প অর্থে এ নগরের অধিকাংশ পথচারীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা সম্ভব। পথচারীদের পরিশ্রম, অগ্রাধিকার নীতি, মানসিক এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিবেচনা করে নগর যাতায়াত পরিকল্পনা গ্রহণ হবে এই আগামীর প্রত্যাশা।
# I am pedestrian, safe crossing is my rights.#pedestrian, #Walking