Thursday, July 26, 2012

ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পিত উন্নয়নে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-র ভূমিকা”

বাংলাদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকা এখন পৃথিবীর দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোর অন্যতম। নানা সংকটে এই নগরের বর্তমান অবস্থা শোচনীয়। বাসস্থান, যাতায়াত, বিনোদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ মৌলিক ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পুরণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে নাগরিকদের। নগর পরিকল্পনা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, সমন্বয়ের অভাব, অদূরদর্শিতা, জবাবদিহীতার অভাব এবং স্বার্থনেষী গোষ্ঠীর প্রভাবসহ নানা কারণে এ সমস্যাগুলোর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

একটি পরিকল্পিত রাজধীন হিসেবে এ নগরকে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু এ সংস্থাটি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ নগরে বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে। রাজউক এদেশের জনগনের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর করতে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আলোচ্য এই প্রবন্ধে এ সংস্থাটি নানা সমস্যার পাশাপাশি সমাধানের বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। আমরা আশা করি সকলেরই এই প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করণীয় বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোপাত করবেন।

রাজউকের গঠনের প্রেক্ষাপট:
ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক অবকাঠামো, নগরীর ভবিষ্যত শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৫৬ সালে ”টাউন ইপ্রুবমেন্ট এ্যাক্ট (টি.আই.এ্যাক্ট) ১৯৫৩” এর আওতায় ডি. আই. টি গড়ে তোলা হয়। ডি.আই.টি সরকারের মূল কাজ ছিল পরিকল্পনা এবং উন্নত শাসন। পরবর্তীতে ডি.আই.টির পরিকল্পনাজনিত সমস্যা সমাধানে ১৯৮৭ সালের ৩০ এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো উন্নয়ন, উন্নতি, বিস্তার এবং শহর নিয়ন্ত্রণ, সঠিক উন্নতিশীল পরিকল্পনা এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাহ্যিক এরিয়া নিয়ন্ত্রণ।

বিভাগ, লোকবল কার্যক্রম: 
রাজউকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শাখাসমূহ হচ্ছে এষ্টেট শাখা, নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখা, নকশা অনুমোদন শাখা। রাজউকে এ মুহূর্তে সব মিলিয়ে পদের সংখ্যা ১০৮১ জন এবং এর মধ্যে ১৯৮ পদ শূন্য রয়েছে। রাজউক বোর্ডে চেয়ারম্যান এবং পাঁচ জন সদস্য আছেন। এছাড়াও আছেন প্রধান প্রকৌশলী, সচিব এবং সাত পরিচালক।

রাজউক কর্মকর্তারা প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত:
রাজউকের প্রকল্পের তালিকার দেখলে দেখা যাবে অতীতে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও তাদের বিশাল এক প্রকল্পের তালিকা রয়েছে। এ সকল তালিকার মধ্যে রয়েছে আবাসিক প্লট, রাস্তা তৈরি, পার্ক তৈরি, ব্রিজ তৈরি, পার্কিং তৈরি, আর্পাটমেন্ট তৈরি, স্যাটেলাইট সিটি তৈরিসহ নানা প্রকল্প। রাজউকের মানব সম্পদের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়েছে এই সকল কর্মকান্ডের জন্য।

উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, মনিটরিং, নগর পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাব
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যস্ত থাকার কারণে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, মনিটরিং, নগর পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতা এ সংস্থার দূর্বলতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীতে পাঁচ সহস্রাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এসব ভবনকে ঘিরে পাঁচ হাজার মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। অপর তথ্যে প্রকাশ প্রায় নগরের প্রায় ৯৯ শতাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের অনুমোদিন পরিকল্পনা মানা হয়নি। পাশাপাশি নগরে বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে মার্কেট, আবাসিক প্রকল্প। এ সকল বিষয়গুলো সুপষ্ট প্রমাণ করে রাজউকের মনিটরিং, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের অভাব। সবচেয়ে অবাক ও বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এ প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দিচ্ছে খোদ রাজউকের কর্মরত ব্যক্তিরা। সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো বিভিন্ন কাযক্রমের সাথে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বয় সাধন এই সংস্থার দায়িত্ব হলেও, এ ক্ষেত্রেও ব্যর্থ ও সংস্থাটি। এ সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিদের কারণেই সরকারের এই সংস্থাটির এই ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে।

রাজউক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুনীতি ও অনৈতিক কার্যক্রম:
নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার পাশাপাশি এ সংস্থাটির বিরুদ্ধে অপর একটি অভিযোগ হচ্ছে দুনীতি ও অনৈতিক কার্যক্রম। প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য অর্থ দিতে হয়, আবার অর্থ দিলে অনেক অনিয়মও নিয়মে পরিণত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজউকের এধরনের নিয়ম বিরুদ্ধ কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে অনেক দুঘর্টনা, ভবন ভেঙ্গে পড়া এবং মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষজ্ঞের মতে রাজউকের নীতিমালা বে-আইনি কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাছাড়া রাজউকের প্লট ও ফ্লাট ঢাকা শহরের আবাসিক সমস্যা সমাধানের চেয়ে জমির কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আশার কথা হচ্ছে মহামান্য হাইকোর্ট রাজউকের ৫২ কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে, যা বর্তমানে বিচারধীন রয়েছে। রাজউকের চলমান অব্যবস্থাপনা ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে এই ধরনের আইনী পদক্ষেপ মানুষকে আশান্বিত করে।

সাধারণ মানুষের জমি স্বল্পমুল্যে অধিগ্রহণ করে বিত্তশালীদের প্রদান:
রাজউক এ পর্যন্ত যতগুলোর প্রকল্পের প্লট হস্তান্তর করেছে তাতে কতজন ভূমিহীন মানুষ ভূমি পেয়েছে? এ প্রশ্œটি প্রথমেই করা উচিত। আর যাদের জমি অধিগ্রহণ করার হয়েছে সেই মানুষগুলো কোথায় কেমন আছে, তা খুজে বের করা উচিত। রাজউকের প্লট ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি চলমান ঝিলমিল রেসিডেনসিয়াল প্রকল্প দিয়ে। এ ্প্রকল্পের অধিনে দেশের নাগরিকের কাছে বিভিন্ন আয়তনের আবাসিক প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের জন্য আহবান করা হয়, যেখানে পরবর্তীতে লটারির মাধ্যমে সবাইকে সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। প্রকৃত পক্ষে এ ব্যবস্থাটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের সমতা, সাম্য ও সবার জন্য সমান-সুবিধা প্রদানের নীতির পরিপন্থী। কেননা রাজউক ঝিলমিল প্রকল্পের যে প্রসপেক্টাস ও আবেদনপত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে উন্মুক্ত করেছে, তবে তাতে জমি বরাদ্দের নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেনি। প্রকল্পের নীতিমালটি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে সুকৌশলে সমাজের প্রভাবশালী ও বিত্তবান অংশের মধ্যে প্লটগুলো বিতরন করা যায়। এখানে সব নাগরিকের সমানভাবে লটারিতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।

জাতীয় দৈনিক এ ১৮ টি ক্যাটাগরিতে কী হারে ও সংখ্যায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে তার একটি সারনি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ হয়নি, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে উন্নয়নকৃত এ আবাসিক প্লটগুলো মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগী ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। কেননা এখানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সাংসদ ও বিচারপতিরা যাঁরাই দরখাস্ত করবেন, তাঁরাই প্লট পাবেন।  আর সারা দেশের বাকি নাগরিক লটারির মাধ্যমে প্লট পাবেন এবং সেখানে বিভিন্ন পেশা এবং সরকারি, বেসরকারি খাতকে বিভিন্ন শতকরা হিসাবে বিভক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের নীতিমালা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ (১) ও (২), ২৭ এবং ৪২ (১)-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রকল্পে সরকারি চাকুরিজীবীদের জন্য ২৮ শতাংশ এবং বেসরকারি চাকুরিজীবীদের জন্য ৮ শতাংশ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পেশা ভিত্তিতেই যদি সরকারি জমি বা প্লট বিতরণ করা হবে তাহলে ১৬ কোটি মানুষের প্রধান প্রধান পেশা এবং প্রতিটি পেশার মানুষের সংখ্যা নির্ণয় করে আনুপাতিক হারে প্লটের কোটা নির্ধারণ করা অন্যতম যুক্তি হতে পারে সেখানে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসা, আত্মকর্মসংস্থান, জেলে তাঁতিসহ সব পেশার মানুষের জন্য উন্মক্ত হতে হবে। এখানে ১৮টি ক্যাটাগরি করার কোনো অবকাশ থাকে না। শুধু মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী ও কতিপয় পেশাজীবীদের মধ্যে এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগাভাগি হতে পারে না। এ সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থে জনগণের কল্যাণে তৈরি এই সংস্থাটিকে ব্যবহার করতে এধরনের অসংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম করতে।

নি¤েœ বরাদ্দ সংরক্ষণের চিত্র তুলে ধরা হলো:
১) মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সাংসদ ও বিচারপতিরা যাঁরাই দরখাস্ত করবেন, তাঁরাই প্লট পাবেন। ২) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রত্যেকে আড়াই কাঠার প্লট পাবেন। ৩) মুক্তিযোদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ৩.০০%। ৪) সাংবাদিক (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস) ২.০০%। ৫) সরকারি চাকুরিজীবী ২৮.০০%। ৬) স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকুরিজীবী ১২.০০%। ৭) সশস্ত্র বাহিনী ২.০০%। ৮) ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ৮.০০%। ৯) বেসরকারি চাকুরিজীবী ৮.০০%। ১০) শিল্পী, সাহিত্যিক ও ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব ২.০০%। ১১) বৈদেশিক মুদ্র উর্পাজনকারী ১০.০০%। ১২) মন্ত্রণালয় ০.৫০%।  ১৩) রাজউক ১.৫০%। ১৪) কৃষিবিদ ২.০০%। ১৫) চিকিৎসক ২.০০%। ১৬) প্রকৌশলী ২.০০%। ১৭) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ১.০০%। ১৮) অন্যান্য ২.০০%। সংরক্ষিত ১০.০০%।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) সর্বশেষ ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার ২ লাখ ৩১ হাজার ৫ শ ৯০টি বাড়ীতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস করে। এসব মানুষের শতকরা ৮০ ভাগের নিজের বাড়ী নেই। এছাড়াও ডিসিসির বস্তি উন্নয়ন বিভাগের হিসাবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ৪ হাজার ৮ শ বস্তিতে বসবাস করে প্রায় ৪০ লাখ লোক। যা নগরীর মোট জনসংখ্যার ৩৩ দশমিক ৩৩ ভাগ। এদের অনেকেরই জীবন কেটে যায় রাস্তার পাশে। পূনর্বাসন ছাড়াই অনেক সময় ব্তি উচ্ছেদের শিকার হতে হয় এসব দরিদ্র মানুষকে। নগর গবেষণা কেন্দ্র্রের প্রতিষ্ঠাতা নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকার মাত্র ৩০ ভাগ মানুষের নিজস্ব মালিকানাধীন আবাসস্থল আছে৷ ৩০ ভাগ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন৷ আর বাকি ৪০ ভাগ থাকেন বস্তিতে৷ যাদের বাড়ী নেই, ভূমি নেই তাদের  ঠায় হয়নি এই রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রকল্পগুলোতে।

দখলদার-অমানবিক আচরণে ব্যবহার কারা হ্েচছ জনগনের সংস্থাটিকে:
দুনীতি, অব্যবস্থাপনাসহ নানা অভিযোগের পর এ সংস্থাটির বিরুদ্ধে দখলদারিত্বেরও অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জলাধার সংরক্ষনের ব্যর্থতা এবং এ সকল জলাধার অন্য ব্যক্তিদের দখল বা ভরাটের পিছনে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মরত ব্যক্তিদের ইন্ধন বা নিস্ত্রিয়তার নানা অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ খিলক্ষেতের ডুমনি ইউনিয়নের ডুমরি খালের উদাহরণ  দেয়া যেতে পারে, ডুমনি খাল ভরাটের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী গত ১০ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট দল ১৫ মার্চ সরেজমিনে সেখানে যায় এবং রাজউকের খাল ভরাটের ঘটনার সত্যতা পায়। এ কারণে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ১৬ মার্চ অধিদপ্তরে তলব করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, আড়াই হাজার বর্গমিটার ভরাট হয়েছে রাজউকের দাবি, ভরাট করা হয়েছে ২০০ বর্গফুট।

অমানবিক কার্যক্রমের বিষয়ে হাজারে অভিযোগ রয়েছে।  নগরের অনুমোদিন মার্কেট, বাড়ী বা হাউজিং থাকলেও এ সকল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে এ সংস্থার কর্মরত ব্যক্তিরা বরাবরই দূর্বল। অপর দিকে দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরদের মাথাগোজার ব্যবস্থা না করে বস্তি উচ্ছেদের ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ রয়েছে।

জিন্দা পার্ক এ ধরনের কার্যক্রমের অপর একটি প্রকৃত উদাহরণ। জিন্দা পার্ক পূর্বাইল এলাকায় একদল তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। জীববৈচিত্রপূর্ণ এই পার্ক অত্র এলাকার হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবকার পথ। প্রথমেই অধিগ্রহণ এলাকার মধ্যে পড়েছে বলে এই পার্ক উচ্ছেদের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে। পরে জনগনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। বর্তমানে এ পার্কটি প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমানে পরিচালনাধীন ব্যক্তিদের নিকট হতে নিয়ে নতুন করে টেন্ডারের করার পায়তারা করছে। কি বা এমন নীতিভ্রষ্ট হয় যদি এই পার্কটি প্রতিষ্ঠাতাদের চালানোর ব্যবস্থাপনা দেয়া হয়। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মানুষের জন্য, মানবিকতার জন্য। আমরা আশা করি রাজউক এধরনের ক্ষেত্রে মানবিক হবে।

নগরে চাপ কামাতে, স্যাটেলাইট সিটি নয় বরং পাশ্ববর্তী এলাকায় যোগাযোগ জরুরি
নগরগুলো হয়ে উঠছে শোষনের ক্ষেত্র। সারা দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে নগরে গড়া হচ্ছে নানাসুবিধা। আর অর্থের অভাবে যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশের মতো মৌলিক সুবিধাগুলো হতে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের বাকী অংশের মানুষ। রাজধনী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হলে, এ সংস্থার নানা প্রকল্প ঢাকার যানজট ব্যবস্থাকে আরো প্রকট করে তুলছে। মিশ্র এলাকা ভেঙ্গে ফেলা, অপরিকল্পিত মার্কেট অনুমোদন, হাউজিং কোম্পানিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং নিজেদের হাউজিং বানিজ্যে সম্পৃক্ত হওয়া এ সমস্যার অন্যতম কারণ।

রাজধানীর সাথে আশে পাশের এলাকাগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা করতে না পারা, রাজউকের চিন্তা ও পরিকল্পনা সীমাবদ্ধতার প্রকৃত উদাহরণ। জনগণের জায়গা অধিগ্রহন করে, জনগণের অর্থে একের পর এক স্যাটেলাইট সিটি না গড়ে, যদি নারায়ণগঞ্জ, কুমিলা, টাঙ্গাইল, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, নরসিংদী ইত্যাদি আশে পাশের শহরের সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যেতো তবে বিকেন্দ্রীয় করণের সুবিধার সাথে সাথে নগরে আগত মানুষের চাপ অনেক হ্রাস করা যেতো।

ক্রমাগত এত ভুলের পরও সংস্থাটির বিভিন্ন হাউজিং তথা স্যাটেলাইট সিটি তৈরি কার্যক্রম চলমান। যা নগরের পরিবহন সমস্যাকে অদুর ভবিষ্যতে আরো প্রকট করবে। সাধারণ মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে কাদের জমি দেয়া হয়েছে, কতজন ভুমিহীন মানুষ ভূমি পেয়েছে এবং যাদের ভূমি অধিগ্রহণ করেছে তাদের কি অবস্থা তা অনুসন্ধান করে উচিত। পাশাপাশি রাজধানীর আশে পাশের এলাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, হাউজিং কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ আরোপে মনোযোগী করতে এই সংস্থার স্যাটেলাইট সিটি বিষয়ক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

একটি পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনায় ব্যর্থতা:
১৯৫৬ সালে গঠিন এই প্রতিষ্ঠানটি অতিক্রম করেছে প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে একটি পরিকল্পিত নগরের উপহার দিতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা। রাজধানীতে অধিবাসীর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে। এই বাড়ন্ত অধিবাসী ও নগর অবকাঠামোর হিসাব মাথায় রেখেই ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছিল দুই হাজার চার সালে। দীর্ঘ ছয় বছর পর চূড়ান্তভাবে ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। পরিকল্পনাটার উদ্দেশ্য, ঢাকাকে একটা পরিকল্পিত বাসযোগ্য নগর হিশাবে গড়ে তোলা। আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্য এলাকা, রাস্তঘাট, কৃষি জমি, বন্যা প্রবাহ এলাকা, খোলা জায়গা, বিনোদন পার্ক, খেলার মাঠ, জলাধার, প্রতœতাত্ত্বিক স্থান ইত্যাদি আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে পরিকল্পনাটিতে।

নগর বন্যামুক্ত রাখা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুবিধার জন্য ড্যাপে সুপারিশ করা হয়েছে একুশ শতাংশ জমি জলাধার হিশাবে রাখার। কিন্তু পরিকল্পনাটি নেয়ার পরও আবাসন ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে ও প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছে। রাজউকের তখন এসব কাজে বাধা দেয় নাই, তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই রাজউকের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছিল। তাছাড়া রাজউক নিজেই এমন অনেক জমি বেআইনিভাবে ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। এখন সরকার এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বেআইনিভাবে ও জোর করে দখল করা জমি রক্ষা করতে আবাসন ব্যবসায়ীরা ড্যাপের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিয়েছে। ড্যাপের নানা সুবিধান বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি অভিযোগ উঠছে উম্মুক্ত স্থান রক্ষা, মিশ্র এলাকা, জলাধার রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদ্যমান ড্যাপের বহুলাংশের দূর্বলতা রয়েছে। যা সার্বিকভাবেই এই দীর্ঘ সময়ে একটি পরিকল্পনার নগর পরিকল্পনার অন্তরায় হিসেবেই প্রতীয়মান হয়।

রাজউক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিষ্ঠন। এটি জনগনের স্বার্থ রক্ষায় জনগনের অর্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। তবে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আইনী দূর্বলতা এবং কতিপয় ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বার্থের কারণে রাজউক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালণ করতে পারছে না। এই নগরকে বসবাসযোগ্য করতে রাজউককে শক্তিশালী করতে হবে এবং অধিকাংশ নাগরিকের কল্যাণে যাতে কাজ করতে পারে সেইভাবে গড়ে তোলা হবে। আর এর জন্য সকলকেই নিজ নিজ অবস্থান হতে এগিয়ে আসতে হবে।

সুপারিশ:
১.    রাজউকের সকল প্রকার স্যাটেলাইট সিটি, ফ্ল্যাট, প্লট, হাউজংি প্রকল্প বাণিজ্য বন্ধ করা;
২.    রাজউকের পরিকল্পনা প্রণয়ন, মনিটরিং, সম্বয়ন, আইন প্রয়োগের বিষয়ে মুল দৃষ্টি প্রধান করতে হবে;
৩.    জোনিং প্রথার পরিবর্তে মিশ্র এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা করা;
৪.    স্যাটেলাইট সিটির পরিবর্তে আশে পাশের জেলাগুলোর সাথে নগরের রেল ও নৌ যোগাযোগ স্থাপনে পরিকল্পনা গ্রহণ;
৫.    রাজউকের প্রধানকে অবশ্যই নগর পরিকল্পনাবিদ হতে হবে। তাছাড়া পরিবেশবিদ, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদদের বোর্ডে অন্তভক্ত করতে হবে;
৬.    ভুমির অযৌক্তিক দাম নিয়ন্ত্রণ করা;
৭.    বেসরকারী আবাসিক প্রকল্পের ক্রেতাদের স্বার্থরক্ষায় রাজউকের আর দায়িত্বশীল হতে হবে;
৮.    প্রকৌশলী, নগরপরিকল্পনাবিদসহ পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ ও বাজেটে অর্থের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা;
৯.    দুনীতিগ্রস্থ ব্যক্তিতের শাস্তি আওতায় আনা;
১০.    বেসরকারী আবাসিক প্রকল্পগুলোর বেআইনী ও অবৈধ কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা;
১১.    বিগত দিনে প্রকল্পগুলোর সুবিধাভোগী ও অনিয়মত তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করা;
১২.    দুনীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও শাস্তির ব্যবস্থা করা;
১৩.    রাজউকের বিভিন্ন সময় বরাদ্দকৃত সকল প্লট ও ফ্যাট বরাদ্দ প্রাপ্তিদের তালিকা প্রকাশ করা;
১৪.    ঢাকা শহরের আগামী ১০০ বছরের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করা;