ঢাকার যানজট একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। রমযান মাসে নানা কারণে যানজট সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারন করে। যা সর্বসাধারণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যানজট হ্রাসের লক্ষ্যে যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার, গণপুর্ত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ পর্যন্ত নানা কার্যক্রম গ্রহণ করলেও প্রত্যাশিত ফলাফল এখনো নগরবাসী পায়নি। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফ্লাইওভার ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট ভাঙ্গাসহ নানা কর্মকান্ড প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করায় যানজট বেড়ে গেছে এবং ক্রমশ এটি বাড়তেই থাকবে। আর এ অবস্থার পরিত্রাণের লক্ষ্যে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ঢাকা বর্তমান অবস্থানকে যানজট না বলে প্রাইভেট গাড়ীর জট বলাই শ্রেয়। দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত না করা, নগরে বিআরটিসির সার্ভিসকে সংকুচিত করা, পথচারীদের পথ রুদ্ধ করা, এবং রিকশা-সাইকেলের মতো বাহনগুলোর চলাচলের কোন ধরনের সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি। বরং নীতিনির্ধারণী পর্যায় হতে ব্যক্তিগত সুবিধাকে চিন্তা করতে গিয়ে প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করার প্রেক্ষিতে যানজট দিন দিন প্রকট আকার ধারন করেছে। প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দূর্বলতা এবং পাবলিক পরিবহনের প্রতি উদাসীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে এ তথ্য হতে, ২০১০ সালে প্রাইভেট গাড়ী নেমেছে ২৬ হাজার ২৪৪ টি আর বাস নেমেছে ১ হাজার ২৪৩টি। অপর দিকে ২০১১ প্রাইভেট গাড়ী নেমেছে ১০ হাজার ২৮৯টি (জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত) এবং বাস নেমেছে ৬৫৬টি।
বর্তমানে ঢাকায় মোট প্রাইভেট গাড়ী চলাচল করে ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৪২৪টি এবং যাত্রবাহী বাস ১৮ হাজার ৪২৬টি (তথ্যসূত্র: http://www.brta.gov.bd/statistic/ motor-vehicles--DK-06-09-11.pdf)। ঢাকা শহরের রাস্তায় আজকের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ প্রাইভেট গাড়ী। ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৪২৪টি প্রাইভেট গাড়ীর অর্থাৎ কার, জিপ ইত্যাদিতে মাত্র ৫% যাতায়াত হয় (তথ্যসূত্র: DHAKA URBAN TRANSPORT NETWORK DEVELOPMENT STUDY (DHUTS) 2010০। প্রাইভেট গাড়ী চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে ঢাকা শহরের ৯৫% যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষকে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। আর এ অবস্থা দ্রুত সমাধানে প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই। রমযানে যানজট নিয়ন্ত্রণে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ও যৌক্তিকতাগুলো তুলে ধরছি।
প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ
* রমজানে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা;
* ঢাকার সকল রাস্তায় কঠোরভাবে গাড়ী পার্কিং নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়ন;
* একদিন জোর অপর দিন বেজোড় নম্বরের গাড়ী চলাচলের নির্দেশনা প্রদান। প্রাইভেট গাড়ীর যাত্রীদের এক গাড়ীতে একাধিক যাত্রী চলতে উৎসাহী করা।
* ব্যস্ত এলাকায় প্রাইভেট গাড়ী প্রবেশ সম্পুর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা;
* মার্কেটগুলোর সামনে গাড়ী পার্কিং বা গাড়ী থামানো নিষিদ্ধ করা;
* অবৈধ পার্কিং বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও জনগণের অভিযোগ জানাতে যোগাযোগের নম্বর প্রদান;
* ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তরের) প্রস্তাবনা অনুসারে শুধুমাত্র প্রাইভেট গাড়ী প্রবেশের ক্ষেত্রে কর আরোপ করা। সিটি কর্পোরেশন (দক্ষিণ) এ এই ব্যবস্থা চালু করা;
পাবলিক পরিবহন সংক্রান্ত (বাস ও রেল)
* স্কুল কলেজে প্রদত্ত বাসগুলো সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন রাস্তায় চলাচলের জন্য প্রদান;
* রাস্তার মোড়ে বাস থামা বন্ধে দৃষ্টিগোচর চিহ্নসহ বাস থামার ব্যবস্থা ও বাস্তবায়নে পুলিশ মোতায়ন;
* নিউমার্কেটসহ বাস থামার যেসকল স্থান (বাস বে) পার্কিং জন্য দখল হয়েছে তা উদ্ধার করা;
* বাস মলিকগণ রুট পারমিট অনুসারে বাস রাস্তায় নামাচ্ছে কি না তা মনিটরিং করা;
* বাস মালিকরা রাস্তায় গাড়ী কম নামিয়ে যাতে সংকট সৃষ্টি না করতে পারে এ বিষয়ে সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
* ইফতারের পূর্বে বেপরোয়াভাবে যাতে গাড়ী চলাচল না করতে পারে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
* অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে মোবাইল কোর্ট ও অভিযোগ প্রদানে নম্বর প্রদান;
* কমিউটার (যাত্রীবাহী) ট্রেন আরো বৃদ্ধি করা ও সময় সুচী ও স্টেশনের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি;
* কমলাপুর হতে ট্রেন যাত্রীরা নেমে যাতে মতিঝিল, শাহবাগ, গুলিস্থান, মগবাজার, নিউমার্কেট এ সকল এলাকায় সহজে যেতে পারে তার জন্য বিআরটিসি-র বাস প্রদান করা।
* টঙ্গী-কমলাপুরে মধ্যবর্তী স্টেশনগুলো হতে যাত্রী উঠা-নামার এবং স্টেশনে যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত করা।
পথচারীদের যাতায়াত
* নিরাপদে পথ চলাচলের জন্য ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং বন্ধ এবং মোটর সাইকেল চলা নিষিদ্ধ বিধান বাস্তবায়ন করা।
* ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং বন্ধ এবং মোটর সাইকেল চলা বন্ধে অভিযোগ করার নম্বর প্রদান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
* নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পথচারীদের যাতায়াতে উৎসাহী করতে সকল রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং অংকন নিশ্চিত করা।
* পথচারীদের জন্য সড়ক পারাপারে ট্রাফিকদের সহযোগিতা প্রদানে নির্দেশনা প্রদান করা।
সিএনজি
* সিএনজির মিটারে সকল স্থানে চলাচল নিশ্চিত করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও অভিযোগের নম্বর প্রদানের সুযোগ রাখা।
* সিএনজিগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে দাড়ানোর স্থান চিহ্নিত করে দেয়া।
রিকশা
* রিকশা ভাড়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
* রিকশাগুলো দাঁড়ানোর স্থান নিশ্চিত করা।
* সারিবদ্ধভাবে রিকশা চলাচলের বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা (যাত্রীদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহী করা)।
* রিকশা লেনে গাড়ী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা।
হকার ব্যবস্থাপনা
* পুরো ফুটপাত দখল করে বানিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করা।
* হকারদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে ফুটপাতে আংশিক জায়গা দিয়ে বসার জন্য পুলিশ ও সিটিকর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।
প্রস্তাবনা সপক্ষে বিস্তারিত আলোচনা
প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ
ঢাকা শহরের প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ না করা সম্ভব হলে কোন ভাবেই যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। রমজানে সময় ঢাকার প্রাইভেট গাড়ীর পাশাপাশি ঢাকার বাইরে হতে প্রচুর গাড়ী শহরে প্রবেশ করে। ফলে এই নগরে যানজট আরো প্রকট হয়। সহজে ও যত্রতত্র পার্কিং সুবিধা প্রাইভেট গাড়ী চলাচলে অনেক বেশি উৎসাহী করছে। পার্কিং সুবিধা বন্ধ করা হলে ঢাকার রাস্তায় গাড়ী চলাচল অনেক হ্রাস পাবে। পাশাপাশি একদিন জোর অপর দিন বেজোড় গাড়ী চলাচলের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা। প্রাইভেট গাড়ীর যাত্রীদের একাধিকজন একটি গাড়ী ব্যবহারের জন্য উৎসাহী করতে প্রচারণা করা।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও মেট্রোপলিটন পুলিশ ইতিমধ্যে একাধিক রাস্তায় রিকশা নিষিদ্ধ এবং সিএনজি গাড়ীর লাইসেন্স প্রদান সীমিত করেছে। অতীতের ধারাবাহিক পদক্ষেপের আলোকে প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ/ কিছু রাস্তায় নিষিদ্ধে সংশ্লিস্ট বিভাগগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
পাবলিক পরিবহন সংক্রান্ত (বাস ও রেল)
ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন অনেক জরুরি বিষয়। কিন্তু দূভার্গজনক হলেও সত্য ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পাবলিক পরিবহন চলাচলের ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এক কোটি-র বেশি জনসংখ্যার যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন বাসের সংখ্যা যাত্রবাহী বাস ১০ হাজার ৬৮২টি। তার মধ্যে কয়টি চলাচল করে তাও আবার নিরীক্ষার বিষয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় এক সময় বিআরটিসি-র ডবল ডেকার এবং সাধারণ বাস চলাচল করতো। কিন্তু পরিবহন মালিকদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে এ সকল রুটে বাস বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে নগরে যে সকল বাস চলাচল করে তা কোনটাই মান সম্মত সার্ভিস দিতে পারছে না। এমতবস্থায় বিআরটিসি-র বাস প্রতি রুটে পরিকল্পিতভাবে চলাচল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রমজানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, এজন্য এসকল রুটের বাসগুলো পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন রুটে চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিআরটিসি বাসগুলো দেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের জন্য। কিছু মানুষ সুবিধা পেলেও বাসগুলো অধিকাংশ সময় বসে থাকছে। অথচ পরিকল্পিতভাবে গণপরিবহন হিসেবে নিয়মিত চলাচল করলে অনেক মানুষ সুবিধা পেতো। নগর যাতায়াতের জন্য বিআরটিসি নতুন বাস ক্রয় করার হলেও, একটি অংশ চলাচল করছে আন্তঃজেলায়। ঢাকা শহরের এক রুট হতে অন্য রুটে যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় মানুষ প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ বিআরটিসি-র সকল বাস এবং বাস বে( বাস রাখার স্থান) সঠিক ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। রেলের সাথে সমন্বয় করে বিআরটিসির বাসগুলো চলাচলের জন্য স্থান, সময় নির্ধারণ জরুরী।
পথচারীদের নিরাপদ যাতায়াত
পথচারীরা নির্ধিরিত স্থান দিয়ে চলাচল করে না এই অভিযোগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং পরিকল্পনা সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের। কিন্ত নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পারাপারে একজন পথচারীদের কি পরিমান মানসিক ও শারিরীক সমস্যা এবং প্রতিবন্ধকতা সম্মুখীন হতে হয় তা অনেকই উপলব্ধি করতে পারেন না। মহামান্য হাইকোর্ট গত ৭ মার্চ ২০১২ তারিখে পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলানো বন্ধসহ কতিপয় নির্দেশনা প্রদান করে। নগরে পথচারীদের নিরাপত্তায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পদক্ষেপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করেছি, আর এ প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষনের তথ্যাদি তুলে ধরছি।
জেব্রা ক্রসিং ও সাইন সংক্রান্ত সমস্যা
আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিভিন্ন স্থানে জেব্রা ক্রসিং অংকন করা হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে অংকিত এ সকল জেব্রা ক্রসিংগুলো রয়েছে নানা সমস্যা। অবকাঠামোগত সমস্যা হচ্ছে, জেব্রা ক্রসিং থাকলেও অনেক স্থানেই পারাপারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, কোন জেব্রা ক্রসিং এর শুরু অথবা শেষে গর্ত বা ড্রেন রয়েছে, ক্রসিংগুলো উচু নিচু অর্থাৎ সমান্তরাল নয়, জেব্রা ক্রসিং এ অসম্পুর্ণ রেইজ ওয়াকওয়ে (উচু হাঁটাপথ), যা শুধুমাত্র শাহবাগ রয়েছে এবং অনেক স্থানে জেব্রা ক্রসিং এর পূর্বে গাড়ী থামানোর জন্য দাগ নেই।
অবস্থান ও দুরত্ব বিষয়ক সমস্যা ক্ষেত্রে রয়েছে অধিকাংশ স্থানেই জেব্রা ক্রসিং অনেক দুরুত্বে, যা সর্বোচ্চ ২০০ মিটার এর মধ্যে থাকা প্রয়োজন, জনবহুল স্থান এ স্বচ্ছন্দে পারাপার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং নেই এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও ইন্টার সেকশনে জেব্রা ক্রসিং নেই।
সিগন্যাল ও সাইন ক্ষেত্রে যে সমস্যা রয়েছে তা হলো জেব্রা ক্রসিংগুলিতে সিগন্যাল বাতি এবং সাইন নেই, অনেক স্থানে সাইন আছে, কিন্তু জেব্রা ক্রসিং মুছে গেছে, অনেক স্থানে সিগন্যাল বাতি আছে, কিন্তু কাজ করে না। পথচারীদের পারাপারের জন্য কোন ধরনের সিগ্যন্যাল নেই।
গাড়ী ও গাড়ী চালকদের সমস্যা
ঢাকা শহরের পথচারীদের নিরাপদ পারাপারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা গাড়ী। গাড়ীগুলো পথচারীদের পথ চলার অধিকারকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত করছে। গাড়ী চালকরা জেব্রা ক্রসিং দখল করে দাড়িয়ে থাকে, কোন চালকরাই জ্রেবা ক্রসিং-র পূর্বে দাগ মানছে না, প্রতিনিয়ত পথচারীদের অধিকার লঙ্গন করলেও গাড়ী চালকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বাস, মিনিবাসগুলো বেপরোয়া চালনার প্রতিয়িত আতঙ্কিত করে পথচারীদের। এছাড়া ধানমন্ডি, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যা নামতেই চলে উচ্চশব্দের ব্যবহারের পাশাপাশি গাড়ীর বেপরোয়া গতি প্রতিযোগিতা। আর এ প্রতিযোগিতার কারণে আতংকিত, কখনো কখনো দূঘর্টনার শিকার হয় পথচারী।
ফুটপাত সমস্যা
ঢাকা শহরের ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য অভিযোগ বরাবর হকারদের দিকেই থাকে। অথচ ঢাকা শহরের কয়েকটি স্থান ব্যতীত অধিকাংশ স্থানের ফুটপাত দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ী, হুডা, দোকানো মালপত্র বা সাইন বোর্ড। এছাড়া কোথাও কোথাও ফুটপাতগুলো ভেঙ্গে দোকান ও বাড়ীতে গাড়ী প্রবেশের জন্য নিজেদের মতো রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যা পথচারীদের নিরাপদ চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
ফুটপাতে হকারদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও। ফুটপাত ভেঙ্গে গাড়ী প্রবেশের ব্যবস্থা করার প্রেক্ষিতে মার্কেট বা বাড়ীর মালিকদের উপর কোন ধরনের আইন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফুটপাত ভাঙ্গার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি হকারদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফুটপাতের পাশে বসার ব্যবস্থা করা জরুরি। ফুটপাতগুলোর কোনটাই বৃদ্ধ, অসুস্থ্য রোগী, প্রতিবন্ধী, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী নয়। অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজগুলো খাড়াভাবে নেমে গেছে। এছাড়া ভাঙ্গা, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমস্যাতো বরাবরই রয়েছে।
হকার উচ্ছেদ নয়, ব্যবস্থাপনা জরুরী
পরিকল্পিত ফুটপাত শুধুমাত্র স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাতায়াতের জন্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফুটপাতে হকার ব্যবসার মাধ্যমে দেশে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের সুশৃঙ্খলভাবে বসার ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে আরো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। বেকারত্ব হ্রাস পেলে সামাজিক অপরাধও কমে আসে। তাছাড়া ফুটপাতে হকার থাকলে তাদের সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্র হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলকারীদের আকর্ষণ করে এবং মানুষ সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পারে। ফুটপাতে হকার নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্ব পালন করে। সুতরাং হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করতে ফুটপাতে হকারদের ব্যবসা করার জন্য নিয়ন্ত্রিতভাবে বসা ও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যা তাদের জীবন মানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা বন্ধ-ভাড়ছে ভাড়া- সাধারণ মানুষ যাতায়াত কিভাবে করবে
ঝিগাতলা হতে একজন রোগী বা বয়স্ক ব্যক্তি কিভাবে পিজি হাসপাতালের যাবে? এটি একটি রাস্তার ক্ষেত্রে প্রশ্ন নয়, ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায়ই একই অবস্থা। ঢাকার বিভিন্ন রুটে রিকশা বন্ধ করা হচ্ছে। কারা কোন পরিকল্পনা বা গবেষণার প্রেক্ষিতে বা কখন করবে তা এই নগরবাসীর অজানা। রাস্তা বন্ধের প্রেক্ষিতে রিকশা চলাচলে ক্ষেত্র সীমিত হলেও, ভাড়া বাড়ছে দিন দিন। এই রিকশা ভাড়াও নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বা অনন্যা সংস্থাগুলো।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৮.৭% ট্রিপ হয় রিকশায়। নারীদের ক্ষেত্রে ৪৭.৪% এর যাতায়াত এর জন্য রিকশা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং স্কুলে ৪১% যাতায়াত হয়। এই মানুষগুলো কিভাবে চলাচল করবে যখন এ বিষয়টি চিন্তা না করেই রিকশা বন্ধ করা হয়। তখন এ বলার অপেক্ষা রাখে সাধারণ মানুষের যাতায়াত পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারকদের এখনো বিবেচ্য বিষয় নয়। গাড়ীতে চলাচলকারী মানুষের জন্য এ চিন্তা যত সহজ। সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য তত কঠিন। এই মানুষগুলোর সুবিধা নিশ্চিত করতে রিকশার জন্য পৃথক লেন এবং ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
সাইকেলের পৃথক লেনের ব্যবস্থা
অসহনীয় ভাড়া বৃদ্ধি এবং যানবাহনের নানাসীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে ঢাকা শহরের অনেকেই এখন সাইকেল ব্যবহার করতে দেখা যায়। সাইকেল পরিবেশ বান্ধব এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী একটি বাহন। অথচ এই পরিবহনটি নিরাপদে চলাচলে জন্য নেই পর্যাপ্ত সুযোগ। সাইকেলের জন্য পৃথক লেন এবং পর্যাপ্ত স্ট্যান্ড করার হলে অনেক মানুষ সাইকেল ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে।
সিএনজি অটো রিকশা
ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থায় অপর নির্যাতনকারী পরিবহনের নাম সিএনজি। সিএনজি চালকরা নানা অজুহাতে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে থাকে। এক সময় ছিল গ্যাস সংকট, তারপর মালিকদের অতিরিক্ত দৈনিক জমা, আর নিয়মিত অজুহাত যানজটের কারণে আয় হয় না। প্রতিটি যাত্রীকে বাধ্য করা হয় সিএনজিতে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে। গণপরিবহণের অতিরিক্ত ভাড়া ও মানহীন সার্ভিসের কারণে নির্যাতিত সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত যেভাবে ভাড়া বাড়ছে এত অর্থের যোগান কিভাবে দেবে তা কখনো কি নগর পরিকল্পনাবিদ ও নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেন।
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। রেল, নৌ, সড়ক এবং আকাশ পথের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাঙ্গিত লক্ষ্য মাত্রায় পৌছাতে পারছে না। একজন মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে একটি যাতায়াতের মাধ্যম হতে অন্য মাধ্যমে যেতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে একজন যাত্রী যদি সদরঘাট লঞ্চ স্টেশনে নেমে ট্রেন ধরতে চায় তবে যে স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পারবে না। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের যাতায়াতের দূর্ভোগ বৃদ্ধির পাশপাশি বাড়ছে যাতায়াত খরচ এবং অন্যান্য সমস্যা।
পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানব সম্পদের উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। কম খরচে, নিরাপদে, নির্দ্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের অধিকার। সাধারণ মানুষের অর্থে আর বিলাসী প্রকল্প নয়, বরং অধিকাংশ মানুষ সুবিধা বিবেচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবেই যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি সরকার বিলাসী প্রকল্প বর্জন করে অধিকাংশ মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।