Wednesday, November 30, 2011


চাই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা
http://sangbad24.net/
Tuesday, 29 November 2011 00:55

সৈয়দ মাহবুবুল আলম


পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানব সম্পদের উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। কম খরচে, নিরাপদে, নির্দ্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের অধিকার। একসময় এ অঞ্চলে নদীপথই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ের আবির্ভাব একটি যুগান্তকারী ঘটনা। পরবর্তী ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে সড়ক পথ। তবে কালের পরিক্রমায় বর্তমানে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যতম প্রধান সমস্যা। আর এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজন সমন্বিত একটি যাতায়াত পরিকল্পনা।

সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। রেল, নৌ, সড়ক এবং আকাশ পথের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাঙ্গিত লক্ষ্য মাত্রায় পৌছাতে পারছে না। একজন মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে একটি যাতায়াতের মাধ্যম হতে অন্য মাধ্যমে যেতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে একজন যাত্রী যদি সদরঘাট লঞ্চ স্টেশনে নেমে ট্রেন ধরতে চায় তবে যে স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পারবে না। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের যাতায়াতের দূভোগ বৃদ্ধির পাশপাশি বাড়ছে যাতায়াত খরচ এবং অন্যান্য সমস্যা।

আঞ্চলিক যোগাযোগ
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে এক সময় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌ এবং রেলের প্রধান্য ছিল। কিন্তু দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়ে সড়ক নির্ভর হয়ে পড়েছে। সীমিত ভুখণ্ডের জনবহুল এ দেশে সমন্বয়হীন সড়ক নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রেক্ষিতে বাড়ছে নানা সমস্যা। এ সমস্যা আশু সমাধানের লক্ষ্যে নৌ ও রেলকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আঞ্চলিক অর্থাৎ এক জেলা হতে অন্য জেলায় যোগাযোগে ক্ষেত্রে প্রধান্য দেয়া উচিত রেল ও নৌপথকে। আর এ সাথে সমন্বয় রেখে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা উচিত।

নগর যাতায়াত ব্যবস্থা
বাংলাদেশের নগর যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতার চিত্র আমাদের সকলেরই জানা। ঢাকা চিত্রই আমাদের এ বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। একের পর এক বিলাস বহুল পরিকল্পনা আর পদক্ষেপের পরও যানজট আজ প্রকট। ঢাকা বর্তমান যাতায়াতকে যানজটকে না বলে বরং প্রাইভেট গাড়ীর জট বলাই উচিত। মানুষের যাতায়াতের কথা না ভেবে বরং প্রাইভেট গাড়ীর যাতায়াতের বিষয়কে প্রদান্য দিয়ে পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে এ সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। তথাপিও প্রাইভেট নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ বা ইচ্ছা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

উন্নত দেশের নগরগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে হাটা, সাইকেল, পাবলিক পরিবহন (বাস, ট্রাম, রেল) কে প্রাদান্য দেয়া হয়ে থাকে। অপরদিকে প্রাইভেট গাড়ী বা ব্যক্তিগত পরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ বিপরীত। ঢাকার ক্ষেত্রে হাটা, রিকশা, সাইকেল, পাবলিক পরিবহন বাস চলাচলে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে প্রাইভেট গাড়ী।

যত্রতত্র পার্কিং, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা কারণে এ নগরে স্বল্প মানুষের পরিবহন প্রাইভেট গাড়ী বৃদ্ধি পেলেও, অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা কষ্টকর। কিছু মানুষ তাদের নিজেদের সুবিধার প্রাধন্য দিতে দিয়ে নিজেদের পাশাপাশি সকলের জন্যই সৃষ্টি করতে যানজট। যানজটের অসহনীয় অবস্থা হতে উত্তরনের জন্য সরকারকে প্রথমেই যন্ত্রমনিব প্রাইভেট গাড়ীরজট নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে, পাশাপাশি পাবলিক পরিবহন, হাঁটা, সাইকেল ও রিকশার মতো পরিবহনে যাতায়াতের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

অবহেলিত রেল ও নৌ পথ
নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রেল ও নৌপথের গুরুত্ব অপরিহার্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই নৌ পথ ও রেল পথের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা সড়ককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অতিরিক্তি সড়ক নির্ভরতার কারণে দূর্ঘটনা, দূষণ, জ্বালানি ব্যয়, যাতায়াত খরচ, যানজট ও যানজটজনিত সময়ের অপচয়সহ নানারকম সমস্যা বেড়েছে।

স্বাধীনতার পর গত ৪০ বছরে যোগাযোগ খাতে যেভাবে সড়ককে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ঠিক তার বিপরীতে রেল ও নৌ-পথকে অবহেলা করা হয়েছে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের অতিরিক্ত সড়কপ্রীতি, মোটরযান ব্যবসায়ীদের প্রভাব ও প্রশাসনিক দূর্ণীতির কারনে সার্বিক সড়কসন্ত্রাসের সামনে আজ নৌ ও রেলপথ অসহায়, বিপর্য্যস্ত ও ধ্বংসোন্মূখ।

সড়ক নির্ভরতা বৃদ্ধিজনিত কারণে ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু-পঙ্গুত্ব পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ব্যাহত করছে। অন্যদিকে দুর্ঘটনার কারণে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্বের জন্য পারিবারিক পর্যায়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক নির্ভরতার কারণে বায়ু দূষণ, শব্দদূষণসহ নানারকম পরিবেশ দূষণ এবং এসব দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, স্ট্রোক, বধিরতাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। যা সামগ্রিকভাবে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে, কারণ অধিকাংশ জ্বালানি দেশের বাইরে থেকে আমদানী করতে হয়। সড়কনির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে যানবাহন বেড়েছে, যেজন্য বৃদ্ধি পেয়েছে যানজট ও যাতায়াত ব্যয়।

নদীমাতৃক দেশ হওয়ায মুগল শাসনামলে এবং ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমনে নদীপথ ক্রমশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রেলপূর্ব সময়কালে বাংলার যোগাযোগের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল নদীপথ। বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই নৌপথে যাতায়াত করা যেত। রেনেল লিখেছেন “বাংলার পূর্বাঞ্চল ছিল স্বভাবতই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অভ্যন্তরীণ বানিজ্যকেন্দ্র, কারণ, নদীগুলি এমনভাবে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত যে জনগণ সব প্রধান স্থানেই জলপথে সহজে যাতায়াত করতে পারত”।

জলপথ সম্পর্কে আলেকজান্ডার ডাও যথার্থই বলেছেন, “জলপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে বাসিন্দাদের মধ্যে বাণিজ্যিক আদান প্রদানের অনেক সুবিধা হযেছে। প্রত্যেক গ্রামেই আছে খাল, প্রত্যেক পরগণাতে আছে নদী এবং সমস্ত দেশ জুড়েই রয়েছে গঙ্গা যার বিভিন্ন মুখ বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, ফলে পণ্যদ্রব্য রপ্তানির পথ প্রশস্ত।” কিন্তু কালের পরিক্রমা আর নদীপথের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নদীপথের পরিমাণ কমছে, তৈরি হয়েছে নানা সঙ্কট।

১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু। মূলত বৃটিশরা এ অঞ্চল থেকে সস্তা পণ্য দ্রুত পরিবহনের মাধ্যমে বানিজ্যিক সুবিধা সৃষ্টি ও বৃটিশ সরকার কর্তৃক বিশাল ভারতকে শাসনের সুবিধার্থে সৈন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে নেওয়ার লক্ষ্যে রেললাইন স্থাপন করলেও পরবর্তী সময়ে জনসাধারনের সুবিধা তৈরি হয়। উল্লেখ্য যে, ১৮৮৫ সালের ৪ জানুয়ারী ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংযোগের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথম এককভাবে রেললাইনের আগমন ঘটে এবং এ বছরের ১ আগষ্ট তারিখে রেললাইন ময়মনসিংহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এরপর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ চলে।

রেলওয়ে আগমনের পূর্বে স্থলপথে এই অঞ্চলে খুবই কম অঞ্চলে ব্যবসা কার্যক্রম ও পরিবহনের কাজ সংঘটিত হতো। রেললাইন স্থাপনের পর রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করেই নতুন বাজার সৃষ্টি হতে থাকে। মূলত বানিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে রেল স্টেশনগুলি থেকে বিভিন্ন স্থানে যোগান সড়ক নির্মাণের ফলে যথেষ্ট পরিমাণে রাস্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বানিজ্যিক এবং জনপরিবহনের জন্য একতরফাভাবে সড়কপথের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। ভবিষ্যতের পরিবহন চাহিদা পূরণের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়াই ব্যাপক পরিমাণে রাস্তা নির্মাণ করা হয়।

বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় রেলওয়ে, নৌ পথের প্রতি অবহেলা ও সড়ক কেন্দ্রিকতার চিত্র সংক্ষেপে:
● একসময় বাংলাদেশে ২৪,০০০ কিমি জলপথ ছিল। বর্তমানে তা দাড়িয়েছে ৫৯৬৮ কিমি এ, যার মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে ৩৮৬৫ কিমি সচল থাকে।
● ১৮৬২ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বালাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ২৮৫৮.২৩ কিমি রেললাইন স্থাপিত হয়। যা মাঝখানে কমে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর নতুন রেললাইন স্থাপনের পর এখন ২৮৩৫.০৪ কিমি রেললাইন বিদ্যমান রয়েছে।
● ১৯৪৭ সালে ৪৬১.৮ কিমি পাকা সড়ক থাকলেও এখন কাঁচা পাকা মিলে ২,৭০,৫৬৫ কিমি সড়ক রয়েছে। এছাড়া ১,১৪১ কিমি ছোট বড় সেতু রয়েছে।
● বাংলাদেশে ২০০৩ সালে সবধরনের নিবন্ধিত যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্য ছিল ৭,৩৭,৪০০ বর্তমানে এই সংখ্যা ১৫,৯৬,০০০ এ উন্নীত হয়েছে।
● বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ, এবং মালবাহী ওয়াগন এর সংখ্যা যথাক্রমে ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত লোকোমটিভ ৪৮৬ থেকে ২৮৬ নেমে এসেছে, যাত্রী পরিবহন কোচ ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত ছিল ১৬৪৩ টি যা বর্তমানে কমে গিয়ে ১৫০৯টিতে নেমে এসছে, মালবাহী ওয়াগন ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত কমে দাড়িয়েছে ৫,০৪,৮৯৩ থেকে ১,৬৬,০১৬ টিতে।
● রেলওয়ের লোকবল ৫৮,০০০ হাজার থেকে ২৭,৯৭১ এ নামিয়ে আনা হয়েছে।
● রেলওয়ের এত সংকোচনের পরও যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০০০-০১ সাল থেকে ২০১০-১১ সালে কিমি হিসেবে যথাক্রমে ৪২০,৯০,০০,০০০ থেকে ৭৬১,১০,০০,০০০ যাত্রী পরিবহন করা হযেছে।
● দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ রেলে যাতায়াত করেন। দেখা যায় শীতাতাপ এ ০.০৫%, প্রথম শ্রেণীতে ১.৩৬% এবং ২য় শ্রেণীতেই যাতায়াত করেন ৯৮.০৬% যাত্রী। সুতরাং বাংলাদেশ রেলওয়ে দারিদ্রপীড়িত এই দেশে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে বলে গণ্য করা যায়।
● সর্বশেষ ২০০৯-১০ সালে রেলওয়েতে দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ১১জন এবং আহত হয়েছেন ১৩৯ জন। সড়কপথে ২০০৮ সালে দূর্ঘটনায় ২৭২৩ জন মারা যান এবং মারাত্মকভাবে আহন হন ৬৫৮ এবং আরো ১৫০ জন আহত হন।
● ২০০৭ সালের হিসেবানুযায়ী যাত্রী পরিবহনে প্রতি কিমি এ খরচ পড়ে রেলে ০.৩৮, নৌপথে ০.৪২ এবং বাসে ০.৮৭ পয়সা। অথচ রেল ও নৌপথে ভাড়া না বাড়লেও সড়কপথে বর্তমানে যাত্রী পরিবহনে প্রতি কিমি এ খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ১.৩৫ পয়সা। একই বছরের হিসাবানুযায়ী প্রতি টন মালামাল পরিবহনে খরচ পড়ে যথাক্রমে রেলে ১.৪৯, নৌপথে ১.২৫ এবং সড়ক পথে ২.৫৮ পযসা।
● ১ টি মালবাহী ট্রেন ২১০টি ৫ টনি ট্রাকের সমপরিমান মালামাল পরিবহন করতে পারে।
● একই পরিমান ট্রাফিক ইউনিট পরিবহনে রেল ও সড়ক পথের মধ্যে ট্রেনের চেয়ে কার ৮.৩ গুণ এবং ট্রাক ৩০ গুণ পরিবেশ দূষণ করে।
● ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে দেখা যায়, রেলে যাত্রী প্রতি ০.৯৫-১.০৬ লিটার তেল খরচ হয়, আর বাসে যাত্রী প্রতি ৪ থেকে ৬.২২ লিটার তেল খরচ হয়।
● অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগের ৬৫% রেল থেকে এবং সড়ক পথ থেকে উঠে আসে ৩৫%।
● ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের হিসেবে তুলনামূলক যাতায়াত ভাড়া জনপ্রতি রেড়ে ১০০ থেকে ৬৬০ টাকা পর্যন্ত এবং বাসে ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। আর ঢাকা থেকে বরিশাল রুটে নৌপথে ১০০ থেকে ৬০০ টাকা আর বাসে ৩৫০ টাকা ভাড়া লাগে। উল্লেখ্য বেশিরভাগ মানুষ ১০০টাকার টিকিটে লঞ্চে যাতায়াত করে থাকে।
● স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে রেল, নৌ এবং সড়ক পথে অসমভাবে বিনিয়োগে করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০৭-০৮ সালে রেল, সড়ক ও নৌপথে যথাক্রমে অর্থ বরাদ্দ এর চিত্র হচ্ছে রেলে ৩.১১ থেকে ২ শতাংশে নেমেছে, সড়ক পথে ৫.১৩ থেকে ৮.৭২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং নৌপথে ৩.৭৬ থেকে কমে দাড়িয়েছে ০.৫৪ শতাংশ।

উপরোক্ত তথ্যসমূহ সহজেই প্রমাণ করে যে রেল ও নৌপথ তুলনামূলকভাবে যতটাই নিরাপদ, সাশ্রয়ী, ও সুবিধাজনক বাহন ততটাই উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবহেলিত থেকেছে। এর ফলাফল আমরা হাতে নাতে পেতে শুরু করেছি। পরিবহন ব্যবস্থায় দূর্ঘটনা, খরচ, জ্বালানী অপচয়, দূষণ বৃদ্ধি, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভর্ট মেরামত ও নির্মাণসহ অবকাঠামো ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

সড়ক সম্প্রসারণ করতে গিয়ে প্রতিদিন শত শত একর ফসলি জমি ধবংস হচ্ছে। যা খাদ্য সঙ্কট তৈরির অন্যতম কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। অথচ নদীপখ সচল রাখা রেলের জায়গায় ডাবল-ট্রিপল লাইন করা হলে, চার লেন আট লেন সড়কের কথা চিন্তা করতে হত না। এমনকি অতিরিক্ত সড়কপথ ও সেতু নির্মাণ পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করেছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে নৌযান চলাচলে।

বর্তমানে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন রেল লাইন স্থাপন, লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বৃদ্ধির উদ্যোগ করা হলেও তা আশঅনুরূপ নয়, আর নৌ পথের উন্নয়নে এখন পর্যন্ত তেমন কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিতই হয় নি। অথচ সড়ককেন্দ্রিক উন্নয়নের এখনও জোয়ার চলছে। চার লেন আট লেনের সড়ক, সেতু, উড়াল সড়কের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

রেলওয়ের নামে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যেমন-সময়মতো ছড়ে না, টিকিট পাওয়া যায় না, শিডিউল ঠিকমতো হয় নি ইত্যাদি। নৌ পথেও স্বাভাবিক চলাচল করা যায় না চরের কারণে। কিন্তু সকল সমস্যা সহজেই দূর করা সম্ভব। কিন্তু সাধারণের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, সড়ক পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক ও দেশের একটি মহল তাদের বানিজ্যিক স্বার্থে এই দুইটি টেকসই মাধ্যমকে পঙ্গু করে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করে থাকেন। সংবিধানানুযায়ী জনসাধারণের মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। পরিবহন ব্যবস্থায় কম খরচে, নিরাপদে রাষ্ট্রের জনসাধারন চলাচল ও মালামাল পরিবহন করবে এটি অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। সুতরাং সরকার এ বিষয়টি বিবেচনা করে ক্রমান্বয়ে সড়ককেন্দ্রিকতা থেকে পরিবহন ব্যবস্থায় রেল ও নৌ পথকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেবে এটি সময়ের দাবী।

প্রতিদিনই দূর্ঘটনা ঘটছে - নিরাপরাধ জনমানুষের অসহায় মৃত্যু ও অপঘাতের এ যেন এক নিরন্তর মিছিল! তাই সারাদেশ জুড়ে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন চলছে। সরকারও এ বিষয়ে কাজ করার জন্য বিবৃতি প্রদান ও আশ্বাস দিয়ে চলেছেন। এখনই সময় পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের চাহিদা মেটানোর জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার যথাযাথ বাস্তবায়ন করা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক পথ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিচালনা ও মেরামতের সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ না থাকা, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে শিথিলতা, আইন সংস্কারের মাধ্যমে যুগপোযোগী না করা, নির্বিচারে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক নির্মাণ, দূর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি না হওয়া, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ইন্সটিটিউশনাল সুবিধা না থাকা, সড়কে দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকা, সড়কে প্রয়োজনীয় সংকেত ও নির্দেশনা সম্বলিত সাইন না থাকা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোÑ ইত্যাদি নানা কারণে সড়ক দূর্ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলছে।

এজন্য সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দূরদর্শীতার সঙ্গে বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে নিরাপদ যাতায়াতের জন্য একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়ক নির্ভরতা কমিয়ে রেল ও নৌ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই দুইটি মাধ্যমের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি, যান্ত্রিক ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানো, পর্যাপ্ত যানের ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণ এর পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এছাড়া নিরাপদে পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।

সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দূর্ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সড়কে দূর্ঘটনার কারণে অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। গত ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাই এলাকায় প্রায় ৫০টি শিশু অকালে মারা গেলো। এছাড়া গত ২ আগস্ট নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার আমতলা এলাকায় এক সড়ক দূর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং ৫০ জন আহত হন। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থানে সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলে পুরো পরিবার সঙ্কটে পড়ে। এছাড়া দূর্ঘটনায় কেউ আহত হলে তার চিকিৎসার জন্য ঐ পরিবারের বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। রাষ্ট্রের ব্যয়ও হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সড়ক দূর্ঘটনার কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সম্প্রসারিত সড়ক নেটওয়ার্ক এখন যেন মৃত্যুজাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যোগাযোগের অন্যতম দুইটি নিরাপদ মাধ্যম রেল ও নৌ ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা, সড়ককেন্দ্রিকতা এবং পথচারীদের প্রাধান্য না দেওয়ার কারণেই মানুষের যাতায়াত হয়ে উঠছে অনিরাপদ ও বিপজ্জনক। যার পরিণতিতে মানুষের অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ মৃত্যু হ্রাসে একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যে ব্যবস্থায় রেল ও নৌ হবে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যমে।

No comments: