Wednesday, November 30, 2011

উন্নতির বাধা সেবাখাত বাণিজ্যিকীকরণ


উন্নতির বাধা সেবাখাত বাণিজ্যিকীকরণ
সৈয়দ মাহবুবুল আলম
http://www.barta24.net

সবাই চায় দেশ এগিয়ে যাক সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে। দেশের সম্পদ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানেও তাই বলা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ নং অনুসারে “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে (কৃষক ও শ্রমিক) এবং অনগ্রসর জনগণের অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।” অনুচ্ছেদ ৭ অনুসারে জনগণই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা উৎস। অনুচ্ছেদ ৪৭ অনুসারে বাংলাদেশে রাষ্ট্রয়াত্ত্ব সব প্রতিষ্ঠান এবং খনিজ সম্পদের মালিক জনগণ। কিন্তু দেখা যায়, বিপরীতে রাষ্ট্রীয় সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে মানুষকে সংবিধানের দেয়া অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নির্বিচারে শ্রমিক ছাঁটাই করে দেশে দারিদ্র ও বেকারত্ব বাড়ানো হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বব্যাংক,আইএমএফ এবং এডিবি’র মতো ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঠেলে দেয়।এভাবে গরিব মানুষের সম্পদ লুটপাট করে নেয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এসব করা হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু এসব গরিব দেশে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেনি। জনগণের সম্পদ ব্যক্তির খাতে তুলে দিয়ে জনগণকে ব্যক্তির হাতে জিম্মি করা সংবিধান সম্মত নয়। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি করায় মানুষের অর্থনীতি,পরিবেশ,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। দেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে বহুজাতিক কোম্পানি ও গুটিকয়েক ব্যক্তির কাছে।

এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)নিজের অর্থ খরচ করে গবেষণা করে দেখাতে চেয়েছে, টাটার বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য লাভজনক। কারণ টাটাকে ঋণ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে এডিবি। বিনিয়োগের সুবিধা বোঝা যায় মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন দিয়ে।গ্রামীণফোন বিনিয়োগের প্রথম চার বছরের বিনিয়োগকৃত অর্থের ৯০% সদর দফতরে ফেরত পাঠিয়েছে।এডিবি’রও বিনিয়োগও আছে গ্রামীণফোনে। আর এটি হচ্ছে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের ব্যবসার ফর্মুলা।

২০০৮ সাল থেকে দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আমাদের সকলের জানা। আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এসব রাষ্ট্র ব্যাংক,রেলসহ বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করেছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ায় সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পয়সা দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে। আর ঠিক একই সময়ে একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

সেবাখাত বাণিজ্যিকীকরণ
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বেশিরভাগ চুক্তিই শিল্পজাত পণ্য বিনিময় সম্পর্কিত। বাণিজ্য ও সেবা সম্পর্কিত চুক্তি গ্যাটস’র মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিমালা সেবাখাতেও সম্প্রসারিত করা হয়। যেখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ব্যাংকিং থেকে খুচরা দোকান স্থাপন পর্যন্ত। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে সেবাখাতের অংশ দুই-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির অর্ধেক। সেবাখাতের বাণিজ্য বিশ্ব বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ এবং এই পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে।

গ্যাটস চুক্তিতে একটি কাঠামো স্থির করে হয়েছে।এটা এজন্য যাতে মৌলিক বাধ্যবাধকতাগুলো সব সদস্য দেশের ওপর সমভাবে প্রয়োগ করা যায়। মোস্ট ফেভারড নেশনের (আর্টিকেল) বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সব অংশীদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এর সময়সীমা ১০ বছর। পাঁচ বছর পরপর পর্যলোচনা করে তা ঠিক করতে হবে। এ চুক্তিতে বলা হয়েছে,উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রযুক্তি ও তথ্য চ্যানেলের প্রবেশের সুযোগ দিয়ে এবং বাণিজ্যে উদারীকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সেবা বাণিজ্যের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হবে। যেসব অভ্যন্তরীণ বিধিনিষেধ সেবা বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে সেগুলো ধীরে ধীরে অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। চুক্তিতে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে দায়িত্ব,লাইসেন্স বা সনদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতার একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড মেনে চলার দায়বদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট এবং মার্কেট অ্যাকসেস- এ দুটো ধারা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদেশী সেবা ও সেবা প্রদানকারীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো সব ধরনের বাধা দূর করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। যেমন,কোনো দেশ সেবা বাণিজ্যের মোট সেবা প্রদানকারী কোম্পানির সংখ্যা বা সেবার মূল্যসীমা বা সেবা সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা বেঁধে দিতে পারবে না। একইভাবে সেবাসংস্থা সংক্রান্ত আইনি বিধি-নিষেধ,যা বিদেশী পুঁজি বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করে,তা দ্রুত দূর করতে হবে। চুক্তির অধীনে (আলোচনা সাপেক্ষে)সেবাখাতে জনশক্তি স্থানান্তরের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়ার বিধি রয়েছে। ব্যাংকিং খাত ও টেলিযোগাযোগ খাতে এ চুক্তির বলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও উদ্যোক্তাদের মতো সমান সুযোগ পাবেন।

সেবাখাত এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ অর্থনীতিতে সেবাখাতের অবদান দ্রুত হারে বাড়ছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় সেবাখাত সংক্রান্ত চুক্তি (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস বা গ্যাটস’র) মাধ্যমে সেবাখাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার অধীনে আনা হয়। এ চুক্তির অধীন সেবাখাতকে ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৬০টি উপখাত। মূল খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে,ব্যবসায়িক সেবা, যোগাযোগ সেবা,নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল সেবা,বিতরণ সেবা, শিক্ষা সেবা,পরিবেশগত সেবা,আর্থিক সেবা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ও সামাজিক সেবা,পর্যটন ও ভ্রমণ সংক্রান্ত সেবা,বিনোদন সেবা এবং অন্যান্য সেবা,যেগুলো কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

ভর্তুকি,ঋণ,সহায়তা,বিনিয়োগ এবং অনুদান
দেশের সব নাগরিক সরকারকে কর দেয়। সরকারও কর আদায় বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। নাগরিক হিসেবে এই কর দেয়ায় আমরা কিছু সেবা পাব। কিন্তু যদি রাষ্ট্রীয় সব সেবাখাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তবে প্রশ্ন জাগে,জনগণ কেন সরকারকে কর দেবে? একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য জনসাধারণকে চাপ দেয়া এবং অপরদিকে রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলো সংকুচিত করছে সরকার। এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না।

কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মানুষদের বিভ্রান্ত করা হয়। ভতুর্কি,ঋণ,সহায়তা,বিনিয়োগ এবং অনুদান যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন,এর ব্যয় বহন করতে হয় জনগণকে। অথবা বলা যেতে পারে, জনগণের অর্থে এসব খাতে খরচ করা হয়। ঋণলগ্নিকারী সংস্থাগুলো জনগণের কল্যাণে সেবাখাতে ভর্তুকি দেয়াকে নিরুৎসাহিত করে এবং ভতুর্কিকে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে অবহিত করে। বিপরীতে সরকারকে একের পর এক ঋণ গ্রহনে উৎসাহী করে আন্তর্জাতিক এসব সংস্থা। অথচ ঋণ ও ভর্তুকি এ দুই খাতের অর্থই জনগণকে বহন করতে হয়।

ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও বিগত কয়েক বছরে এ দেশের দরিদ্রতা বেড়েছে তিনগুণ। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সালের ভেতরে দুই কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার লোক বেকার হবে। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কমলেও ঋণ অর্থ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ এ সময়ে এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। দেশের প্রতিটি শিশু ১১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বাংলাদেশকে এক ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেড় ডলার। আর এসব ঋণের একটি বড় অংশ গ্রহণ করা করা হয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অহেতুক খাতে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে,অপরদিকে তাদের দোসর কোম্পানির হাতে এ দেশের মানুষের সম্পদ তুলে দিচ্ছে বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে। ২০০৭ সালের সরকার বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে রাজস্ব বাজেটে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ ব্যয় করেছে। এভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আজগুবি সূত্রে পিষ্ট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের জনগণ।

স্বাস্থ্যসেবা যখন হয়ে পড়ে চিকিৎসা সেবা
সমৃদ্ধজাতি গড়ে তুলতে স্বাস্থ্য সেবাকে প্রাধান্য দিতে হবে। স্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়া খুব জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে, চিকিৎসার চাইতে রোগ প্রতিরোধ করাই ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা হয়ে পড়েছে চিকিৎসাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ চিকিৎসা সেবাকেই দেখানো হয় স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে। তাই রোগ প্রতিরোধ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ সচেতনভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে অধিকাংশ রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। রোগ প্রতিরোধ ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা বা লিফলেট,পোস্টারে মানুষের চিকিৎসার সহযোগিতা পাবার আকুতি শুনতে পাই আমরা। যেসব মানুষের কিছুটা সুযোগ আছে, তারা তাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারে। অথচ অনেক মানুষ আছে যারা রোগের চিকিৎসা করাতে পারছে না, পাশাপাশি তাদের সমস্যাও তুলে ধরতে পারছে না। আর এভাবে কত মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব? এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,বাংলাদেশের আট লাখ ক্যান্সার রোগীর সাত লাখই চিকিৎসা পাচ্ছে না। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বসান্ত হচ্ছে মানুষ,এমন নজির অনেক রয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টকে সামনে রেখে,আমাদের নির্ধারণ করতে হবে আমরা কি রোগের চিকিৎসার জন্য মনোযোগী হব,না রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান করব। স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখার কারণে রোগ প্রতিরোধে মনোযোগী না হয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার একটি রমরমা বাণিজ্য কেন্দ্র। আর অর্থ উৎপাদনের এই আধুনিক কৌশলের শিকার সাধারণ মানুষ। চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী হাসপাতালের অনুমতি দেয়া হলেও,আগের তুলনায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের পরিমাণ অনেকাংশে বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি,যেখানে দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই,সেখানে স্বাস্থ্যসেবা খাতের বাণিজ্যিকীকরণ মানুষের জীবন ধারণ আরো কঠিন করে তুলবে।

বহুজাতিক কোম্পানির খপ্পরে বিদ্যুৎসেবা
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার সার্বজনীন ও মৌলিক। কিন্তু শহরের মানুষ যখন চাকচিক্যময়তা, বিনোদন এবং আরাম আয়েশের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করে,ঠিক একই সময়ে গ্রামের মানুষজন বৈষম্যের কারণে বিদ্যুতের অভাবে চাষাবাদ, দৈনন্দিন কাজ করতে পারে না। বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে বিগত বছরগুলোতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে চড়া সুদে। অথচ দেখা যায়, দেশের বিদ্যুৎখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে,মানুষের কাঁধে চেপেছে ঋণের বোঝা, বাড়ছে বিদ্যুৎ খরচ, হচ্ছে শ্রমিক ছাটাই। বিদ্যুৎখাত বহুজাতিক কোম্পানির খপ্পরে পড়েছে।

পুঁজির বিচলনের অন্যতম শর্ত হলো উন্নয়ন। সার্বজনীন বিদ্যুতায়ন ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। কিন্তু এ কথাও সত্য যে বিদ্যুৎখাত কোম্পানির হাতে সমর্পন করে মানুষের উন্নয়ন সম্ভব না। কারণ কোম্পানি ব্যবসা করছে। লাভালাভের বিষয়টাই তার কাছে প্রধান। আর রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব মানুষের কল্যাণ। এই মৌলিক বোধকে সামনে রেখে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের বিদ্যুৎতায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের যেসব ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পরামর্শ দিচ্ছে, সেসব ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ রক্ষা না হলেও বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার ক্ষেত্রে ঠিকই খোলা রাখা হয়েছে। ঋণের কিস্তি, পরামর্শ প্রদানকারীদের সম্মানী এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নানাবিধ ব্যবসার চক্রে বাইরে চলে যাচ্ছে এ দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব বিদ্যুৎখাত কোম্পানির নামান্তরে বিরাষ্ট্রীয়করণের ওভারহেড খরচ, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা, আইনের লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি বেড়েছে। চাকুরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, শ্রমিক ছাঁটাই,শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

সরকারকে বিদ্যুৎসমস্যা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক,এডিবি ও অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থা বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চাপ দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চাপের ফলে সরকার ১৯৯৬ সালে আইপিপি নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ হাতে নেয়। পিডিবিকে নগদ পয়সায় অনেক বেশি দামে এসব কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ সরকারের হাতে। ২০০৩ সালে সরকারের উৎপাদন ক্ষমতা দাড়ায় ৬৬% এবং বাকি ৩৪% বিদ্যুৎ চড়া দামে বেসরকারি খাত থেকে কিনতে হয়। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ এক সময় পুরোপুরি জিম্মি হয়ে যাবে কোম্পানি বা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের হাতে। সরকারকে বাধ্য হয়ে কম দামে গ্যাস বা জ্বালানি সরবরাহ করে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। আর এই অহেতুক ভর্তুকির জন্য ঋণপ্রদানকারী গোষ্ঠী হতে ঋণ নিতে হবে। এ ঋণ আর বিদ্যুতের চড়া দাম শোধ করতে হবে জনগণকে। কোম্পানির লাভ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার ও জনগণ। বিদ্যুতের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি জনগণের জীবনধারণকে কঠিন করে তুলবে এবং সরকারকে করবে অস্থিতিশীল।

যেখানে ব্যক্তির দুর্নীতি চাপানো হয় প্রতিষ্ঠানের ওপর
কেবল বিভাগীয় শহরেই না; জেলা-উপজেলাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ সেবার ব্যাপারটি নিশ্চিত করছে বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)। অথচ গেল কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম গুরুত্বহীন করে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাত্র এক দিনে ২৭ বছরের পুরানো ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করে বিটিসিএল শিরোনামে কোম্পানি করা হয়।

সবাই এতদিনে জানতো, কেবল লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য,একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরেও বেসরকারি করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিটিটিবি। ১৯৯৮ সালের টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অনুযায়ী আগামী ২০১০ সালের ভেতরে এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেসরকারি করা হবে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ মাত্র। দাতা সংস্থাগুলো দেশের টেলিযোগাযোগ খাতকে পুরোপুরো বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিতে প্ররোচিত করছে বাংলাদেশ সরকারকে। আমাদের সরকারগুলো তা মেনে চলছে।

একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান এমনটিই অভিযোগ বিটিটিবি’র বিরুদ্ধে। এভাবে মাত্র কয়েকজনের অপরাধের দায় চাপানো হয় পুরো প্রতিষ্ঠানটির ওপর। এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির একটি বড় জায়গা হলো ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়। আর এই ক্রয়-প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্মচারীর কোনো সম্পর্ক নেই। অপরদিকে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভিওআইপির দুর্নীতির কথা সবার জানা। ভিওআইপি’র জন্য প্রতিবছর দেশ এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। এই হিসেবে গত কয়েক বছরে দেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। এই অর্থ জমা হয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এভাবে প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি করে হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। বরং ব্যবসা বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিপরীতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিটিবি এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব দেয়ার পরেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার অজুহাত এনে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি বিষয়ক আলোচনায় বিটিবিটির ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতিগুলো তুলে ধরা হয়। অপরদিকে মোবাইল কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি থাকা স্বত্ত্বেও তা জনসম্মুখে তুলে না ধরে পুরস্কৃত করা হয়।

বিটিটিবিকে বিরাষ্ট্রীয়করণের কার্যক্রম পাট,কাগজ ও অন্যান্য শিল্পের মতো করেই হচ্ছে। বিটিটিবি’র নিজস্ব উদ্ধৃত্ত তহবিল আছে। অথচ এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়। এভাবে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দূর্বল করা হয় বিটিটিবিকে।

মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটকের যাত্রা শুরু হয় বিটিটিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে বিটিটিবি থেকে আলাদা কোম্পানি করা হয়েছে টেলিটককে। এভাবে সাবমেরিন ক্যাবেল বিটিটিবির পরিচালনায় শুরু করে বর্তমানে আলাদা কোম্পানি করা হয়েছে। লাভজনক এ প্রতিষ্ঠান দুটিকে আলাদা করায় বিটিটিবি/বিটিসিএল দুর্বল হয়ে পড়েছে। কমেছে বাৎসরিক আয়ের পরিমাণও। এভাবে বিটিটিবিতে একটা মাথাভারী প্রশাসন তৈরি করা হয়েছে,পাঠক তা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন।

অল্প খরচে আরামদায়ক সফরে রেলপথ
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে যোগাযোগব্যবস্থার প্রধান উপায় ছিল নৌ-পরিবহণ। কিন্তু পরিকল্পনার অভাব ও অব্যবস্থাপনায় ধ্বংস হয়েছে নৌপথ। সড়ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই। সরকার রেলের আশানুরূপ বিকাশ ঘটাতে পারেনি গেলো কয়েক দশকে। বর্তমানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে। খুব নিম্নমানের সেবা, ফিটনেসবিহীন বাহন আর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াচ্ছে পরিবহণ মালিকরা। সম্প্রতি বিআরটিসি বন্ধের দাবিতে বেসরকারি মালিকরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। শহর অঞ্চলের বাস, সিএনজি, ক্যাব ভাড়া অনিয়ন্ত্রিত। সরকারি সার্ভিস বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটির কার্যক্রম কমিয়ে আনা হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। শুধু সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানই নয়, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন, জাতীয় অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। রাষ্ট্রীয় রেলের সেবার মানসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। তবুও স্বল্প খরচ ও আরামদায়ক ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেলের ভূমিকার বিষয়ে কারোই দ্বিমত নেই। পরিকল্পিতভাবে রেলের উন্নয়ন করা হলে, এটি দেশের প্রধান জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হবে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সড়ক ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম অপেক্ষা রেল অনেক সস্তা। রেলওয়েকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য ও বিবেচ্য বিষয়ে হচ্ছে রেল সড়ক পরিবহণের তুলনায় অনেকটা নিরাপদ,জ্বালানি সাশ্রয়ী ও দূষণ কম করে। এছাড়া একসঙ্গে অনেক যাত্রী পরিবহণ করে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

পরিবেশ, অর্থনীতি, জনসেবা, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে রেলের অর্থনৈতিক অবদান থাকার পরেও আন্তজার্তিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রেলওয়ের চেয়ে সড়ক পথের উন্নয়নে বেশী আগ্রহী। ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো শর্তসাপেক্ষে রেলওয়ের উন্নয়নখাতে সরকারকে ঋণ দেয়। যা স্টেশন রি মডেলিংয়ের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। ঋণ সংস্থার পরামর্শ ও দিক নির্দেশনায় অনেক উন্নয়ন গৃহীত হচ্ছে। ফলে দেশীয় অনেক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা না থাকায়, আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না রেলের। এক্ষেত্রে দেশীয় বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা জরুরি। আর্ন্তজাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে বিভিন্ন উন্নয়ন নীতিমালা প্রণীত হয়। বিগত দিনে উন্নয়নের নামে এই এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শেই খুলনা বাগেরহাট, মোগলহাট লালমনির হাট, ভেড়ামারা-রায়টা, নরসিংদী-মদনগঞ্জসহ বিভিন্ন রেলপথ বন্ধের মাধ্যমে সংকোচন করা হয়েছে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ।

রেলপথ একটি অলাভজনক যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে যে রেলপথ কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই রেল সেবা ভর্তুকি দিয়ে চলে। কারণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত এই রেলপথ। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নিয়মিত যাত্রী ও মালামাল পরিবহণের পাশাপাশি ডাকপরিবহন,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মালামাল পরিবহণ, ত্রাণ পরিবহণসহ বিভিন্ন সেবা দেয় রেলপথ। কিন্তু বাংলাদেশ রেলের উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ায় এর ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়ছে। এসব বিষয়য়াদিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু মহল রেলকে অলাভজনক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

কৃষিবীজে কোম্পানির পেটেন্ট কেন!
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকের জীবনজীবিকা কৃষিনির্ভর। গ্রামে এখনো ৬০ শতাংশ পরিবার পেশাগতভাবে সরাসরি কৃষি কাজে জড়িত। ১০ শতাংশ মানুষ কৃষির সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রাণবৈচিত্র নির্ভর বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সংখ্যা বেশি। যাদের জমির পরিমাণ তিন একরেরও নিচে। মাত্র ১০ ভাগ কৃষি পরিবারের জমির পরিমান ২ দশমিক ৫ একর থেকে ৭ দশমিক ৪৯ একর। আর এক শতাংশ কৃষক আছেন যাদের জমি সাত একরের বেশি। এই ক্ষুদ্র কৃষকরা সামগ্রিকভাবে এতকাল দেশের মানুষের খাদ্য সরবরাহ করছেন। কৃষির সাথে মানুষের পেশাগত ও খাদ্য ব্যবস্থা যেখানে এতটাই নির্ভরশীল সেখানে দেশের কৃষিখাতে যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এসব কৃষকদের কথা ভাবা উচিত সবার আগে।

কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বলতে এ পর্যন্ত যা এসেছে তা হলো রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচ প্রযুক্তি,ধান-গম ভাঙানোর মেশিন। ষাট ও সত্তরের দশক উফশী প্রযুক্তি আসে। সবুজ বিপ্লব শিরোনামে পরিচিতি পায় উফসী প্রযুক্তি। সেই সময় ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের সরকারকে এই কাজে বাধ্য করে। এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড বীজনীতি ঘোষণা করে। বেসরকারিভাবে বীজ আমদানির অনুমোদন পায় তখন থেকেই। আর এভাবে কৃষিতে বেসরকারিখাতের অংশগ্রহণ বাড়ানো হয়। ধীরে ধীরে বন্ধ করা হয় রাষ্ট্রায়াত্ত্ব সংস্থা বিএডিসিকে। নানা প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কৃষককে বীজ হেফাজতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বীজের ওপর কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কোম্পানির পেটেন্ট। কৃষক কী চাষ করবে সে সিদ্ধান্ত কোম্পানি ঠিক করে দেয়। চিরচেনা কৃষি জমিতে কৃষক কোম্পানির চাপিয়ে দেয়া ফসল চাষ করে।

প্রকৃতির কারিগর কৃষকরা এরপর থেকে
বীজ, সার, কীটনাশক, পানিসহ কৃষিজাত উপকরণের জন্য কোম্পানির দারস্থ হতে হয়। বাংলাদেশের পুরা কৃষি ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়ে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে। কোম্পানিগুলো লাভের পরিমাণ বাড়াতে কৃষকের হাতে তুলে দেয় নিম্নমানের বীজ,সার,কীটনাশক। সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয় কৃষক। অপরদিকে বাড়ছে বীজ,সার, কীটনাশক,পানিসহ নানা উপকরণের দাম। বাড়ছে খাবারের দাম। পরিবহণ ও উৎপাদন খরচের পর কৃষকদের হাতে উদ্ধৃত থাকছে না কিছুই। খাবারে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ছে। হুমকিতে পড়ে গেছে পুরা জনস্বাস্থ্য। অপরদিকে বেশিদামে খাবার কিনতে কিনতে মানুষের অবস্থা কাহিল।

কৃষিবাণিজ্যের ধারা এখনেই থামল না। নতুন করে ধেয়ে আসছে জেনিটিক্যাল খাদ্যের উৎপাদন প্রযুক্তি। কৃষিজাত মুনাফা ও বাণিজ্যিককরণের সঙ্গে লড়াই করে না পেরে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে হাজার হাজার কৃষক কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছেন। ইংল্যান্ড,কানাডার মতো দেশেও কৃষকদের আত্মহত্যার হার সাধারণ নাগরিকের দ্বিগুণ। ওয়েলসে প্রতি সপ্তাহে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন। আমেরিকায় মিডওয়েস্টে কৃষকদের মত্যুর কারণের ভেতরে আত্মহত্যা পঞ্চম প্রধান কারণ। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি নীতির প্রতিবাদে কোরিয়ার কৃষক বীর লী আত্মহত্যা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ। এই মহৎ প্রতিবাদী কৃষক লী ২০০৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নিজের বুকে ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে প্রতিবাদ করেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রণীত কৃষিনীতির। এতকিছুর পরেও কৃষিসম্পদ রক্ষায় সচেতন না হলে আমাদের পুরা খাদ্য সংস্কৃতি চলে যাবে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে।

নানান কৌশলে বেসরকারিকরণ
শুধু বাংলাদেশ না, দুনিয়ার সব গরিব দেশের সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দুর্নীতি একটি কার্যকর অস্ত্র বহুজাতিক কোম্পানির। ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো প্রকল্প নামধারী দুর্নীতি সহায়ক কার্যক্রমের মাধ্যমে দুর্নীতিকে প্রথমে উৎসাহিত করে। পরে এই দুর্নীতি কমানোর অজুহাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতি বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশের জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি, আইন, খাদ্য প্রভৃতি খাতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় বিগত বছরগুলোতে। এসব ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ সংস্কার বা উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে রাষ্ট্রীয়খাতগুলো ধ্বংস করে সৃষ্টি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি বিদেশী ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। এ প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা হচ্ছে দেশীয় বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। দুর্নীতি ও অবস্থাপনা এক শব্দ নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপক দুর্নীতি হিসেবে শনাক্ত করা হয়। দুর্নীতির মূল ক্ষেত্র উচ্চ পর্যায়ে হলেও,অনেক ক্ষেত্রে নিম্নপর্যায়ের অব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতির সাথে তুলে ধরে।

দেশের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাদের কোণঠাসা করা হয় প্রথমে। এরপর রাজনীতিবিদদের তাদের পরামর্শ মানতে বাধ্য করে কোম্পানিগুলো। বিগত দিনে মোবাইল কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত বিল,ভিওআইপির মাধ্যমে দুর্নীতি,নাইকো, অক্সিডেন্টাল,এশিয়া এনার্জির মতো কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধ্বংসী কার্যকলাপে এই ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো নীরবতা পালন করেছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রতিটি সরকারে জন্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের টিসিবি’র মতো প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় করে রাখার কারণে এবং বাজার ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে সরকারের জন্যে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার দুর্বলতার কারণে সিন্ডিকেট ব্যবসার মাধ্যমে দেশের জনগণকে জিম্মি করা হয়। দেশের পরিবহণ, চিকিৎসা, ভোগ্যপণ্য,শিক্ষাখাত অনৈতিক ব্যবসার কাছে জিম্মি। যদি সেবাখাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল খাত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তবে সরকার জিম্মি হয়ে পড়বে,যা জাতীয় নিরাপত্তা,উন্নয়ন ও জনস্বার্থ রক্ষায় হুমকিস্বরূপ।

যদি মানুষের উন্নয়ন করতে হয় তবে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও সক্রিয় করার মাধ্যমেই এই অবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। কোম্পানির হাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তুলে দেয়া হলে,তা তাদের মুনাফা কামানোর উপায়ে পরিণত হবে। মানুষের সমস্যা হবে কোম্পানির ব্যবসায়িক উপকরণ। টাকার অঙ্কে হয়তো জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়বে, হয়তো বাহারি বিজ্ঞাপন, সুউচ্চ ভবন ও দামি গাড়ি হবে। এতে করে আড়ালে ঢাকা পড়বে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের অসহায় জীবন। এটা আমাদের দাবি যে, নীতিনির্ধারকগণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের,যা মানুষকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবে।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম:গবেষক ও আইনজীবী।

No comments: