Thursday, October 20, 2016

জনস্বাস্থ্যকে প্রধান্য দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি

জনস্বাস্থ্যকে প্রধান্য দিয়ে
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন নতুন বিভাগ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে,  জনগনের স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। তবে এ  পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আলোচনা শুধুমাত্র জনসেবক ও জনপ্রতিনিধিদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সরকারে চিকিৎসা কেন্দ্রিক, বর্তমানে মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগের প্রকৃতি বিবেচনা করে সরকারকে জনস্বাস্থ্য বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি। আর এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি জনস্বাস্থ্য বিভাগ গঠন করা।

বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অনেকাংশে সফল হয়েছে, যা বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ (হৃদরোগ, ষ্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়বেটিস) বেড়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৬০% হয় অসংক্রামক রোগে। আমাদের আজকের আলোচনায় বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের রোগ আর মৃত্যু অবস্থা, সরকারী-বেসরকারী চিকিৎসা সেবার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আগামী বছরের বাজেট এবং স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমকে মূল্যায়ণ করার চেষ্টা করবো।

বাড়ছে অসংক্রামক রোগ,

২০১০ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৯৮.৭% এর মধ্যে অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের (হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়বেটিস) ঝুঁকি (ৎরংশ ভধপঃড়ৎ), ৭৭.৪% এর মধ্যে অন্তত দুটি ঝুঁকি এবং ২৮.৩% এর মধ্যে অন্তত তিনটি ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে  প্রায় ১২ লক্ষ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। প্রতিবছর ২ লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ১.৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। জাপানিজ জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (জেজেসিও)-র তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যা নিওপ্লাসিয়া নামে পরিচিত। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকবে ২ কোটি ১৪ লাখ মানুষ।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ২০১৫ সালের গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত  রোগীর সংখ্যা ৭১ লাখ। এর মধ্যে মোট পাঁচ শতাংশ শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে পাঁচ শতাংশ হলো টাইপ টু ডায়াবেটিস, প্রধানতই শিশুরাই এর শিকার। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে ৩,৮২০০০ মানুষ পঙ্গু হয় এবং ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে দেশে ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় মাত্র কয়েক হাজার রোগীকে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। ২০০৯ সালে জাতীয় এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১ লাখ ৬০ হাজার ৮ জন চিকিৎসা নেয়। ২০১৪ সালে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৩৩ জনে।

স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানচেটে বলা হয়- ২০১৩ সালে ১ লাখ ৭৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় স্ট্রোকে এবং ১ লাখ ৬ হাজার মানুষ হার্ট অ্যাটাকে ও ২৮ হাজার মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগে মারা যান। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণের একটি হৃদরোগ।

বাংলাদেশ প্রায় সোয়া দুই কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। ২০১১ সালে মানসিক রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় কোটি।  আরেকটি গবেষণার তথ্য, ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে মানসিক রোগীর সংখ্যা ১৮%। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র সমীক্ষায় দেখা যায় ৭-১৫ বছরের বয়সী শিশু-কিশোরদের ০৮% একাকি থাকতে পছন্দ করে, যার সংখ্যা ৩২ লাখ (দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে)। শিশু-কিশোরদের এই একাকিত্ব তাদেরকে সামাজিক নানা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিবে, যা আমরা ইদানিং কালে অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছি।

অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ যোগ্য, চাই প্রতিরোধের ব্যবস্থা

স্বাস্থ্য সেবাকে শুধু চিকিৎসাকেন্দ্রিক করার কারণে এবং রোগ প্রতিরোধে সম্পুর্ণ উদাসীন নীতির কারণে মরনঘাতি অ-সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সম্পুর্ণভাবে নেই কিন্তু সরকারের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ নীতি থাকলে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে স্বাস্থ্য সেবার আওতায় সম্ভব। আমরা জানি, দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, শরীরচর্চা বা ব্যায়াম বা পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত মাদক সেবন এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, অনিরাপদ খাদ্য অসংক্রামক রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

খাদ্য মানুষের সুস্থ্য থাকার একটি অন্যতম প্রধান শক্তি। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লক্ষ লোক খাদ্যে বিষস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত   হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৪ সালে একই জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের আওতায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে দেখা যায় ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়। এসব খাদ্যে নিষিদ্ধ ডিডিটি থেকে শুরু করে রয়েছে কার্বামেড, কার্বাইড, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, ফরমালিনসহ আরো বেশ কিছু রাসায়নিক-ধাতব মিশ্রণের উপস্থিতি । এ সকল উপাদন শরীরে ক্যান্সারসহ নানা রোগের অন্যতম কারণ।

বাজারের চিপস, ওয়েফার, চকোলেট ও জুসে কার্বোহাইড্রেড, মেলামিন অতিমাত্রায় থাকায় শিশুদের জন্য ক্ষতিকর হলেও এসব খাবারের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ শিশুরা স্থূলতা ও উচ্চরক্ত চাপে ভুগছে, যার প্রধান কারণ শিশুদের এসব বাইরের খাবার খাওয়া। স্থূলতা ও উচ্চরক্ত চাপ ছাড়াও কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ নানা রোগে আক্রান্ত  হচ্ছে শিশুরা। এতে তারা প্রচন্ড স্বাস্থ্য হুমকিতে পড়ছে।

কায়িক পরিশ্রম ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হাঁটা একটি উত্তম মাধ্যম। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-র গবেষণায় দেখা যায় ঢাকা শহরের ৪৪ % রাস্তায় ফুটপাত নেই এবং ৫৬% ফুটপাত হাঁটার উপযোগী নয়।  একটি সুন্দর ও পরিকল্পিত নগরের বাসিন্দাদের জন্য নগরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ খোলা মাঠ ও পার্ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় এ জন্য আছে মাত্র চার শতাংশ জায়গা। । রাজধানীতে গড়ে দুই লাখ ৩০ হাজার ৭৬৯ জন মানুষের জন্য খেলার মাঠ আছে মাত্র একটি। আর অপ্রতুল হলেও এ পার্কগুলোও এখন দখল ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

শিশু-কিশোরদের জীবনচর্চা ও রোগ সমীক্ষায় দেখা যায়, সময়মতো খাবার খায় না ৭৪ শতাংশ, পড়ার টেবিল, বইখাতা গুছিয়ে রাখে না ২২ শতাংশ, দাঁত ব্রাশ করে না ৪ শতাংশ, শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করে না ৫৯ শতাংশ, কাপড়চোপড় নিজে পরিষ্কার করে না ৫৯ শতাংশ, মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে না ১৮ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, প্রতি বছর কমপক্ষে ২৮ লাখ মানুষ অধিক ওজন এবং স্থুলতার কারণে মারা যান। গবেষণার আওতাভুক্ত ১৬ হাজার ৪৯৩ জন নারীর মধ্যে ১৮ শতাংশই অধিক ওজনের অধিকারী অথবা স্থুল। স্থুলতার কারণে তারা ডায়াবেটিস এবং অ্যান্ডমেট্রিয়াল ক্যান্সার, জরায়ু-মুখ ক্যান্সার,  স্তন ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে বলে প্রমাণিত। গ্রামীণ এলাকার চেয়ে শহুরে এলাকায় স্থুলতা এবং অধিক ওজনের প্রাদুর্ভাব বেশি। ঢাকায় বায়ু দূষণে মরছে বছরে ১৫ হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) এক রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুষিত ২৫ শহরের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের তিনটি শহর নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা।

উপরের এ তথ্যগুলো সুপষ্টভাবেই বুঝিয়ে দেয় এমহুর্তে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি সরকারের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমান চিকিৎসা সেবা বরাদ্ধ ও কার্যক্রম রয়েছে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সে ধরনের কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

চিকিৎসা ব্যয়ে বিপর্যস্ত মানুষ

চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬.৪ মিলিয়ন বা ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।  দেশের শতকরা ৭৫ শতাংশ কিডনি রোগী ব্যয়বহুল কিডনী রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সমর্থ হন না। বাংলাদেশ ১২ লক্ষ ক্যান্সার রোগী থাকলেও, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা পায় মাত্র ১ লক্ষ লোক। ২০০০ সালের তথ্য অনুসারে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬০ ভাগ মানুষের নিজের পকেট হতে যায়। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে জনগনের অন্যান্য অত্যাবশকীয় জিনিসের উপর চাপ ফেলছে।

গরীব মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যয়ের বোঝা বহন করা অনেক কঠিন। সামগ্রিকভাবে পরিবারের আয়ের ৮.৮ শতাংশ চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়। কিন্তু গরিবের বেলায় দেখা যায় এর অনুপাত প্রায় ৩৮ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অনেক দরিদ্রই হয় ঋণগ্রস্ত হয় বা জমিজমা বিক্রি করে। হাসপাতালে ভর্তি হলে দরিদ্রদের খরচ আরো বেড়ে যায়। কেননা একদিকে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে, আর কাজ করতে না পারায় আয় কমে যায়।

সাধারণ মানুষের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল সরকার পরিচালিত  স্বাস্থ্য সেবা
সরকার পরিচালিত  হাসপাতালগুলোর সেবার মান ও দুনীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও এ কথা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই দেশের সাধারণ মানুষগুলোর আশ্রয়স্থল হচ্ছে এ সকল হাসপাতাল। স্বাস্থ্য বুলেটিন এর তথ্য অনুসারে ২০১২ সালে বর্হিভিাগে সেবা নিয়েছে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৮১ হাজার ১১৪ জন এবং ভর্তি হয়েছিল ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩১৮ জন রোগী। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৫ তথ্য অনুসারে ২০১৪ সালে ভর্তিকৃত ভোট রোগীর সংখ্যা ৫১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭০ জন। কমিউনিটি হাসপাতালে প্রতিমাসে ৯০ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা সেবা নেয়। তবে রেফারেল ব্যবস্থা না থাকা, ডাক্তারের অনুপস্থিতি, ঔষধের অভাব, নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নষ্ট, অপরিচ্ছন্নতা, হাসপাতালে কর্মীদের দূব্যবহারের কারণে সরকারী চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে থাকে। এছাড়া মহানগর এবং বিভাগীয় পর্যায়ে সরকার পরিচালিত চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা ও বরাদ্ধ বৃদ্ধির কারণে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা ব্যহত হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগে রয়েছে ৪৮টি সেকেন্ডারী ও টারশেয়ারী হাসপাতাল।  আর এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে।

বেড়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা
১৯৮২ সালে একটা অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আইনী বৈধতা দেওয়া হয়।  ১৯৮০ সালে সরকারী পরিচালনায় রাষ্ট্রায়াত হাসপাতাল ছিল ৫১০ টি এবং বেসরকারী ছিল ৩৯ টি, ১৯৯৮ সালে সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে ৬৪৭ টি এবং বেসরকারী হাসপাতালের সংখ্যা দাড়ায় ৬২৬টি। ২০০৫-০৬ সালে এক তথ্যে দেখা যায মোট ৪ হাজার ১৫টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২ হাজার ১৬৮টি একক মালিকানায়  প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে  বাংলাদেশে ১৩৩৪১ টি প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিস ও ডায়গোনেসটিক সেন্টার আছে। সঠিক পরিসংখ্যান নেই।  স্বাস্থ্যখাত একটি বিশাল বানিজ্যিক খাত। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায় ৮ বছরে বেসরকারী চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, দিন দিন এর পরিমান বাড়ছে।

বেসরকারী চিকিৎসার উন্নয়নের লক্ষ্যে  ‘‘বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন ২০০০’’ খসড়া প্রণয়ন করা হয়। আইনটি ২০০৩ ও ২০০৪ সালে আরো অধিকতর উন্নয়ন করে। ২০১০ সালে  “বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা আইন-২০১০’’ (খসড়া) নিয়ে আবার কিছুটা কাজ হয়। বর্তমানে  ‘‘বেসরকারী চিকিৎসা সেবা আইন-২০১৬’’ এর খসড়ার উপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বিগত ১৬ বছরে আইনটি আলোর মূখ দেখেছি, আর এ পিছনে স্বাস্থ্য বানিজ্যের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা রয়েছে। বর্তমানেও শুধুমাত্র চিকিৎসকদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে আইনটি পর্যালোচনা কাজ চলছে। এ ক্ষেত্রে জনস্বার্থ কতটুকু রক্ষা পাবে বা একটি বড় প্রশ্ন।

ঔষধ বানিজ্য
স্বাস্থ্যখাতে অপর এক অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার নাম ঔষধ বানিজ্য। ঔষধ বানিজ্যের চিত্র পাওয়া যায়, ডাঃ মুনির উদ্দিন আহমদ এর লেখায় ‘‘১৯৮১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায়  জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা বাজারজাতকৃত ২ লাখ ওষুধ থেকে মাত্র ২৬টি ওষুধের একটি তালিকা প্রকাশ করে যেগুলোকে অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা হয়।

অধ্যাপক মোঃ সায়েদুর রহমান, ফার্মাকোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ-র মতে মানুষের চিকিৎসার জন্য খরচ করার ৩ টাকার মধ্যে ২ টাকা ব্যয় করে ঔষধে। বাংলাদেশে ঔষধের বাজার প্রায় ১৬০০০ কোটি টাকার। সরকার ঔষধের জন্য ব্যয় করে ৬৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫৩৫০ কোটি টাকার ঔষধ মানুষকে কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১১০০ জেনরিক ঔষধের ২৪০০০ হাজার ব্রান্ড নাম রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যার মতে যে ঔষধ ব্যবহার হয় তার ৫০% প্রেসক্রিপশন বা ডিসপেন্সিং বা বিক্রি পর্যায়ে অযৌক্তিক/ভুল/ অসম্পূণ হয়ে থাকে। দেশে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ঔষধ নিম্ন মানের। সরকার যদি মাত্র ৩০০০ কোটি টাকা ব্যয় করে, তবে সরকার পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের আর বাইরে হতে ঔষধ কিনতে হবে না।

জনস্বাস্থ্য ও বাজেট
বাংলাদেশের বর্তমান রোগ ও মৃত্যু পরিমাণ, কারণ এবং প্রকৃতি, চিকিৎসা ব্যয় ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বিষয় সুপষ্ট হয়।
প্রথমত: বাংলাদেশে প্রতিরোধযোগ্য রোগ ও মৃত্যুর বাড়ছে, দ্বিতীয়ত: চিকিৎসা ব্যয়ের কারণ মানুষ সর্বশান্ত হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে প্রধান্য দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম গড়ে তোলা। এর পক্ষে বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা রয়েছে যা প্রয়োগ করলে অ-সংক্রামক রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক প্রকাশনা অনুসারে নিরাপদ খাদ্য, পরিবেশ সংরক্ষন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, তামাক নিয়ন্ত্রণ, কায়িক পরিশ্রম নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৯টি নীতিমালা এবং ১৭ টি আইন রয়েছে। কিন্ত এ সকল আইন প্রয়োগে  যথেষ্ট গুরুত্ব না পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষন আইন ২০০০, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ এর মতো জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোর বাস্তবায়নে যথেষ্ট ধীর এবং আশানুরূপ নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জড়িত রয়েছে এ সকল আইন বাস্তবায়নে সাথে। সকলের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা ও অর্থের মাধ্যমে অনেক সাশ্রয়ীভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা সম্ভব।

বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার সমস্যা :  বাজেটে অর্থবৃদ্ধি কি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে না চাই সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রধান্য না দেয়া, স্বাস্থ্যখাতের দুনীতি ও অপব্যয়, নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারী চিকিৎসা ও ঔষধ বানিজ্য এ সকল বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ না করে প্রতিবছর বরাদ্ধ বাড়ালেই জনগণের স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি হবে না। স্বাস্থ্য সেবার কোন খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন তার কোন মূল্যায়ন না করে এবং প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে ‘ প্রতিবারের মতোই এবারও টাকার অংক বাড়িয়ে অবকাঠামো ও চিকিৎসার নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, ক্যান্সার, কিডনী, লিভার সিলোসিস, স্ট্রোক, জন্মগত হার্ট ডিজিজ রোগীদের জন্য বরাদ্ধ বৃদ্ধি প্রশংসার দাবিদার। তবে মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা, দেয়ার কাজ স্বাস্থ্য বাজেটের অংশ নয়, এটা সমাজকল্যানের কাজ।

বিগত বছরগুলোতে বাজেটে টাকার অংকে বরাদ্ধ বেড়েছে, আর স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী হিসেবে আমরা হিসেবে করেছি অনুপাত। কিন্তু বড় হওয়া টাকার অংক এখনো একটি ক্ষেত্রে ও  মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। অবকাঠামো, পরীক্ষা নিরীক্ষার মেশিন, ঔষধ ক্রয়ের মতো খাতগুলোতে অবিরাম দুনীতি আর অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রচুর টাকা প্রতিবছর যাচ্ছে কিছু মানুষের পকেটে। বরাদ্ধ যত বাড়ছে বাড়ছে দুনীতি, অপব্যয়ও তাল দিয়ে বাড়ছে।। আর তাই বরাদ্ধকৃত টাকা সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রতি নজর দেয়া জরুরি। যে পরিমান বরাদ্ধ বিগত ৫ বছরে হয়েছে সে  সকল খাতের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কিনা তা নিরীক্ষা, আগামী দিনের উপকরণ ক্রয় বা অবকাঠামো নির্মাণের খাতের ব্যয়ের প্রয়োজনীয়াত কঠোরভাবে নিরীক্ষা করা জরুরি।

স্বাস্থ্য আন্দোলন জনগণের স্বাস্থ্য সবার মান বাড়ানো এবং যারা স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন সেসব এলাকা ও মানুষের জন্যে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবী করছে।  স্বাস্থ্য বাজেটের ক্ষেত্রে সরকারের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রধান্য দেয়ার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি এলাকার চাহিদা নিরুপন এবং বরাদ্ধ ব্যবস্থা চালু, সরকারের রেফারেল ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, ওষুধ উৎপাদন, মূল্য, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো; উপকরণ ক্রয় বা অবকাঠামো নির্মাণের খাতের ব্যয়ে মনিটরিংসহ মতো খাতগুলো ব্যবস্থাপনার লক্ষে বরাদ্ধ ও মনোযোগী হওয়া জরুরি।

No comments: