Thursday, March 31, 2016

ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী আশা ও উৎকন্ঠা

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুসারে আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ হতে সকল তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে/মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী আসার কথা। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের এ সিদ্ধান্ত তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছিল। তবে তামাক কোম্পানিগুলো সতর্কবাণী প্রচলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের মধ্যে উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে।

২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালের আইনের বিধিমালা অনুসারে আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ হতে বাংলাদেশের সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী দিতে হবে। আইন পাশের প্রায় ৩ বছর পর এ ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বিধান আসার পিছনে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। আর এ অবস্থায় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের উৎকন্ঠা যথেষ্ট যৌক্তিক।

তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানকে বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তামাকের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানকে কেন জোর দিয়ে থাকে, এ বিষয়টি একটু ব্যাখা জরুরি। গবেষণায় দেখা যায়, একজন ধূমপায়ী বছরের প্রায় ৭০০০ বার সিগারেটের প্যাকেটে দেখেন। ছবিসহ সতর্কবাণী থাকলে একজন নিরক্ষর মানুষও সহজে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। এ ব্যবস্থা ধূমপায়ীদের ধূমপান ত্যাগে উৎসাহী করে এবং কিশোর তরুণদের ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত করে।

আন্তর্জাতিকভাবে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ব্রাজিলের এক গবেষণায় দেখা যায়, সিগারেটের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী এক তৃতীয়াংশ ধূমপায়ীকে ধূমপান ত্যাগে উদ্ধুদ্ধ করেছে। সিঙ্গাপুরে ৭১% ধূমপায়ী বলেছেন, ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করায় ধূমপানের ভয়াবহ ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছে। বাংলাদেশ এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৯৫.৪% মানুষকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রভাবিত করবে।
বিশে^র প্রায় ৮০টি দেশে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা হয়েছে। এ সকল দেশের মাঝে প্রায় ৬০টি দেশে ৫০%  জুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে নেপাল ৯০% জুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করেছে। ২০১২ অষ্ট্রেলিয়া বিশে^ প্রথম প্লেইন প্যাকেজিং ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থায় তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে কোম্পানি ব্র্যান্ড ছবি, লেগো, ট্রেডমার্ক কোন কিছুই প্রদান করা যায় না। প্যাকেটে একটি নির্দিষ্ট রং থাকে এবং কোম্পানি নির্ধারিত স্থানে এবং ফন্টে শুধুমাত্র ব্র্যান্ড নাম লিখতে পারে।

বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আইনীভাবে নিশ্চিত করা হয় ১৯৮৮ সালে, তামাকজাত সামগ্রী  বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের মাধ্যমে। ১৯৮৮-২০০৬ পর্যন্ত ‘‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর”Ñ ছোট অক্ষরে লিখিত এ সতর্কবাণীই বিদ্যমান ছিল। ২০০৬ সাল হতে নতুন স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নিশ্চিত করা হয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ অনুসারে। ২০১৩ সালে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি-র) আলোকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর বিধান যুক্ত করা হয়।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট/মোড়কের মুলপ্রদর্শনী তলের ৫০% জুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করতে হবে। প্যাকেটে শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত লিখতে হবে। জনস্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ও ঝুঁকি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরির উদ্দেশ্যে, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, কার্টন, কৌটা বা মোড়কে ব্র্যান্ড এলিমেন্ট (যেমন- লাইট, মাইল্ড, লো-টার, এক্সট্রা, আল্ট্রা শব্দ) ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া প্রতি তিন মাস পর পর পরিবর্তিত সতর্কবাণী মুদ্রণ করতে হবে। সরকার ২ বছর পর নতুন সতর্কবাণী প্রদান করতে পারবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত অন্যতম আইন। এ আইন সম্পর্কে বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ, সচেতনতা, সম্পৃক্ততা ও প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ, এ আইন প্রণয়নে আইনী দিকের পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতি, মানুষের অভ্যাস, অবকাঠামো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, ধূর্ত তামাক কোম্পানির কার্যকলাপ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় করা হয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আইন বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতামত গ্রহণ করেছে। প্রতিটি ধারার ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা ঘন্টার পর ঘন্টা বিশ্লেষণ আর যুক্তিতর্কে মিলিত হয়েছেন। আইনটির বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনায় প্রত্যেকেই আইনটি আরো কঠিন করার মতো জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তবে আইন প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্টরা বাস্তবতার আলোকে সুপারিশ প্রণয়ন করেন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অর্জন অনেক, তবে মানুষের প্রত্যাশা এখনো পুরন করতে পারেনি।

আইনটি প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে জনমত সংগ্রহসহ প্রচলিত সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। তারপরও এ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে বিরোধীতাসহ নানারকম ষড়যন্ত্র করেছে তামাক কোম্পানি। ২০০০ সাল হতে ২০১৫ পর্যন্ত আইন প্রণয়ন এবং সংশোধন গঠিত কমিটির সদস্য হয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিগত সময়ে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন কমিটিতে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, প্রতিবারই তামাক কোম্পানি প্রবলভাবে শুধুমাত্র প্যাকেটে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বিরোধীতা করেছে।

২০০৫ সালের আইন ও বিধিমালা প্রণয়নে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত থাকলেও, ২০১৩ সালে এফসিটিসি অনুসারে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। তবে কোম্পানিগুলো সহযোগি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং চিঠি পত্রের মাধ্যমে তাদের বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে যা গণমাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই তাদের বক্তব্য প্রায় একই থাকে। যেমন প্যাকেটে এ ধরনের ছবি ছাপাতে তাদের মেশিন নেই, তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এত স্বল্প সময়ে তারা ছাপাতে পারবে না। আর এ যুক্তিতেই তারা নানাভাবে সময়ক্ষেপন করেছে।

অধিকাংশ মানুষ তামাক কোম্পানিগুলোর বিরোধী থাকলেও, কিছু স্বার্থান্বেষী ও তামাক কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধাভোগী ব্যক্তিকে তাদের পক্ষে কথা বলতে শোনা যায়।  কিন্তু একটি কথা পরিষ্কারভাবে করা প্রয়োজন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্যোগ তামাকজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনাসহ কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং আইনের প্রেক্ষিতে তামাক কোম্পানির বানিজ্য যত কমে আসবে জনগনের স্বাস্থ্য তত ভাল হবে। তামাকজনিত রোগ, মৃত্যু তত কমে আসবে। আর এ ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার কোন বিকল্প নেই।

বিধিমালা প্রণয়নের পর প্রায় এক বছরের সময় দেয়া হয়, সাম্প্রতিক সময়ে তামাক কোম্পানিগুলো মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রে আবার টালবাহানা করছে। এখন তারা বলছে প্যাকেটের উপরের অংশে তারা সতর্কবাণী দিতে পারবে না, নিচে দিতে চায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় এ বিষয়ে তারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে, মন্ত্রীর সাথে দেখাও  করেছে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটের উপরি অংশে সতর্কবাণী প্রদানের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সাথে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের একটি প্রতিনিধিদল স্বাক্ষাৎ করলে তিনি আইন অনুসারে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। গত জানুয়ারি মাসে সার্ক স্পিকার সামিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ হতে বাংলাদেশ ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী অঙ্গীকার এবং আইন ও বিধিমালার বিধান থাকার পরও তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীরা উৎকন্ঠা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নিশ্চিতের লক্ষ্যে ঘরে বাইরে ধারাবাহিত বিভিন্ন কার্যক্রম করে আসছে। তামাক কোম্পানিগুলো হীন ও কুটকৌশল এই উৎকন্ঠার মূল বিষয়। অপরদিকে এ কথাও সত্য, কিছু ব্যক্তি জনগনের স্বাস্থ্যের কথাটা বিবেচনা না করে, তামাক কোম্পানির ক্ষতি হচ্ছেÑএই মনোভাব পোষন করেন। তামাক কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধাভোগীরা ভুলে যান তামাকজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ৫৭,০০০ মানুষ মারা যায় আর ৩৮২০০০ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেন। আর এ ধরনের তামাক কোম্পানির প্রতি সহানুভুতিমূলক মনোভাবের কারণে কোম্পানিগুলো আইনকে পাশ কাটিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। ধূর্ত তামাক কোম্পানির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ বাংলাদেশে সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী আসবে এই প্রত্যাশা।

সমকাল: http://bangla.samakal.net/2016/03/17/200001

No comments: