Monday, February 22, 2016

বৈষম্যহীন কল্যাণকর রাষ্ট্র আমার বাংলাদেশ

বৈষম্যহীন কল্যাণকর রাষ্ট্র আমার বাংলাদেশ
এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম, আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক

ছোট ছোট পায়ে পথ ধরে স্কুলে যাওয়া, সুস্বাস্থ্য আর জ্ঞান মেধায় বেড়ে উঠা পিছনে রয়েছে এই রাষ্ট্রের  লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষের কষ্টের টাকায় গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠান আর অবকাঠামো। অপেক্ষকৃত অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে আমরা অনেকেই প্রশ্ন করি, দেশ আমাকে কি দিয়েছে? অথচ প্রশ্নটা করা উচিত আমরা দেশকে কি দিয়েছি? দেশের মানুষের জন্য কতটুকু করেছি সেই প্রশ্নটাও একবার নিজেকে করা উচিত।

দেশ অনেক এগিয়েছে, দেশ এগিয়ে যাবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক সুচকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত এ সকল অর্জনে সুবিধা কত শতাংশ মানুষ ভোগ করছে, তা বিশ্লেষণ ও নির্ধারণ করে আগামী দিনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি সম্পদের বন্টনের বৈষম্য অব্যাহত থাকে, তবে এ রাষ্ট্রের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।  সুচকে আমাদের উন্নয়ন হলেও সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে আমাদের সুবিধাভোগীদের মানসিক দারিদ্রতা এখনো রয়ে গেছে।

নগরগুলোতে একটি বড় অংশের মানুষ বস্তিতে থাকে। নদীভাঙ্গন বা অর্থনৈতিক সুবিধার লক্ষ্যে এই নগরে আসে। চরম দরিদ্রতার সাথে রয়েছে পানি, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের অর্থে কম দামে জমি কিনে ক্ষমতাবান প্লট তৈরি করে দিয়েছে। এ নগরে ক্ষমতাবানদের জন্য একের পর এক আবাসন প্রকল্প তৈরি হলেও,  দরিদ্র বস্তি বাসীদের জন্য কোন  কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আবাসনের এই বৈষম্য অবসান করা জরুরি।

এই নগরে লক্ষ লক্ষ শিশু রয়েছে। কিন্ত এ শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য নেই পর্যাপ্ত জায়গা। ফুটপাতে প্রায় ২ লক্ষের বেশি স্থায়ী হকার রয়েছে,  যাদের উপর ১৪ লক্ষ মানুষের জীবন নির্ভর করে।  ফুটপাতের হকার উচ্ছেদ হয়। কিন্ত ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং করে রাখতে পারে নির্বিকার ভাবে। দুই লক্ষ প্রাইভেট গাড়ীর জন্য আইন করে ঢাকার প্রতিটি বাড়ীতে, মাকের্টে পার্কিং ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই নগরে শিশু আর হকারদের জন্য নেই পরিকল্পনা আর উদ্যোগ।

বাজেট এদেশের অর্থনৈতিক আইনী দলিল। দেশের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। অপর দিকে কিছু মানুষ ভ্যাট, ট্যাক্স না দিয়ে জমিয়ে নেয় অর্থ। প্রতিবছর বাজেটে কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়, যা বাংলাদেশ সংবিধান পরিপন্থী। বাংলাদেশ সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘‘ রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’’। এক শ্রেণীর মানুষের কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগের মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।

বিদুৎ উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ, কৃষি ও শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্যে বিদুৎতায়নের কথা বলা হয়েছে। এ দেশের নগর দোকান, বিলবোর্ড, রাস্তায় আলোক সজ্জায় যখন ভরপুর থাকে বা প্রচন্ড শীতল এসিতে যখন নগরে মানুষ আরামে ব্যস্ত। তখন অনেক গ্রামেই কৃষির জন্য নূন্যতম বিদুৎ সরবারহ করা যায় না।

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, সংক্রামক রোগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসংক্রামক রোগ। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত মোটা হওয়ার মতো অসংক্রামক রোগগুলোর বৃদ্ধি দেশের জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কায়িক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস তামাক ব্যবহারের কারণে এই অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সকল রোগের রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যয় অনেক। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধন্য দিতে গিয়ে ক্ষতিকর পণ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে অনেক শিথিলতা দেখা যায়।

সম্প্রতি দীর্ঘ ২ বছর পর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাশ করা হল, যাতে তামাক কোম্পানিগুলোকে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানে ১২ মাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও জনস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য না দিয়ে তামাক কোম্পানির স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেয়া হয় না।

সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত উন্নয়নের পূর্বশর্ত।  ঢাকা শহরের অধিকাংশ প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ হেঁটে, রিকশায়, বাস, সাইকেলে চলাচল করে। রিকশায় চলাচল করে একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠী। যানজটের অজুহাতে এ নগরের অনেক রাস্তা হতে রিকশা বন্ধ করা হয়েছে, অথচ গুটি কয়েক মানুষের বাহন প্রাইভেট গাড়ী যে কোন রাস্তায় চলতে পারে। বর্তমানে ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ীর কারণে যানজট হয়। কিন্ত নগরে প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না।এ নগরে প্রাইভট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ করে পাবলিক বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈষম্য নিরসন জরুরি।

এ দেশ এগিয়েছে, এ দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি দেশের পরিবেশ দূষণ কমে আসবে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রাধান্য পাবে, দেশের মানুষের কর্মমুখী শিক্ষার জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। আমরা সুখী কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবো। দেশের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়ন হবে বৈষম্যহীন।

ছবি: ইন্টারনেট