তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন: বাস্তবায়নে ভাবনা
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, আইনজীবী ও নীতিবিশ্লেষক

প্রেক্ষাগৃহে ধূমপান নিষিদ্ধ করার পর ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে ধূমপান নিষেধ বিজ্ঞপ্তি প্রর্দশন করা কোন স্থানে ধূমপান করা হলে দন্ড আরোপের বিধান করা হয়। ঢাকার পর ১৯৭৮ সালে চট্রগ্রাম, ১৯৮৫ সালে খুলনা, ১৯৯২ সালে রাজশাহী, ২০০৬ সালে সিলেট ও বরিশাল মেট্রোপলিটন আইনে অনুরোপ বিধান যুক্ত করা হয়।
সিলেট ও বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও অন্যান্য বিভাগের জন্য ধূমপান নিষেধ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি লংঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমান ১০০ টাকা। ১৯৮৫ সালের পর ১৯৮৮ সালে প্রণয়ন করা হয় তামাকজাত সামগ্রী বিপণণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন । ১৯৯০ সালে বলবৎ আইন অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তামাকজাত সামগ্রী বিপনন (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন অধ্যাদেশ প্রণীত হলেও আলোর মূখ দেখেনি। সর্বশেষে কিছু আইন বাতিল ও কতিপয় আইনের বিধান বলবৎ রেখে প্রণয়ন করা হয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যে ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫। ২০০৬ সালে এই আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যে ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়।
১৮৯০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে মোট ১২ টি আইনের মাধ্যমে ধূমপান ও তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা করা হয়। ২০০৫ সালে আইন প্রণয়নের পূর্বে ১৯১৯ এবং ১৯৮৮ সালের আইনব্যতীত অন্যান্য আইনের মুল বিষয় ছিল ধূমপান নিয়ন্ত্রণ। এ আইনগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু স্থানকে ধূমপানমুক্ত করা হয়। এই আইনগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট সফলতা অর্জন হয়েছে এমন জোরালে তথ্য প্রমাণ নেই।
২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে নির্দিষ্ট পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, প্যাকেটের গায়ে দৃষ্টিগোচর ভাবে পৃথক পৃথক স্বাস্থ্য সতর্কীবাণী প্রদানের বিধান করা হয়। এ আইনের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, প্যাকেটের গায়ে সতর্কবানী নিশ্চিতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং ধূমপানমুক্ত স্থান বিষয়ে সচেতনতার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান হ্রাস পায়। কিন্তু পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে গেছে।
বিদ্যমান আইনের সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োগের নানা সমস্যাগুলো দূর করতে ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ১৮৯০ হতে এ যাবত পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে সংশোধনের জন্য অপেক্ষমান আইনটি বাস্তবায়নের বিষয়ে ভাবনা এখনই প্রকৃত সময়।
বিগত সময়ে অভিজ্ঞতার আলোকে নিঃসন্দেহে বলা হয় ধূমপানমুক্ত স্থান সংক্রান্ত ধারা বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। আইনের এই ধারা বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। আইনের সফলতা ও বিফলতা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ এ ধারা বাস্তবায়নের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ সংক্ষিপ্ত আকারে
সংশোধনী: তামাকজাত দ্রব্য ও কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে সকল তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যেকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ২০০৫ সালের আইন অনুসারে জর্দ্দা বা সাদাপাতার মতো তামাকজাত দ্রব্যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো না।
২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট ও সীমিত ছিল। সংশোধনীতে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা আরো কর্মকর্তাকে এ আইন বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
সংশোধনী: ধূমপানমুক্ত স্থানের বিধান
২০০৫ সালে ধূমপানমুক্ত স্থানের পরিধি কিছুটা নির্দিষ্ট ছিল। বিদ্যমান সংশোধনীতে ধূমপানমুক্ত স্থানের পরিধি, জরিমানা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো:
১. পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞায় নতুন সংযোজিত হয়েছে বেসরকারী অফিস, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেষ্টুরেন্ট, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহনের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার ঘোষিত যে কোন স্থান।
২. পাবলিক প্লেসে জরিমানার পরিমান সর্বশেষ ৩০০ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই ব্যক্তি কর্তৃক দ্বিতীয়বার অপরাধের জরিমানা দ্বিগুন করা হয়েছে।
৩. পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন না করার প্রেক্ষিতে জরিমানার বিধান করা হয়েছে।
৪. পাবলিক প্লেস ও পরিবহন ধূমপানমুক্ত রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উপর দায়িত্ব আরোপের বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ করার বিধান রয়েছে।
সংশোধনী: তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, ইন্টারনেটে তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্যের প্রচারের উদ্দেশ্যে যে কোন ধরনের দান, অনুদান, বৃত্তি প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে উৎসাহী করতে কোন নমুনা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমুল্যে বিতরন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিধানে গুরুত্বপুর্ণ সংযুক্ত হচ্ছে নাটক সিনেমায় সিগারেটের দৃশ্য ব্যবহার নিষিদ্ধ, বিক্রয় স্থলে প্রচারনা বন্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট/কৌটা/মোড়কে অনুরূপ পন্য বিক্রয় নিষিদ্ধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর আড়ালে তামাক কোম্পানির প্রচারণা কার্যক্রম নিষিদ্ধ অন্যতম।
সংশোধনীতে ব্যক্তির পাশাপাশি কোম্পানিকে জরিমানার বিধান এবং জরিমানার পরিমাণ ১ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। একই ব্যক্তি কর্তৃক দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে দ্বিগুন হারে জরিমানার বিধান রয়েছে।
সংশোধনী: তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী
আইনের সংশোধনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী। এছাড়া লাইট, মাইল্ড, লো-টার, এক্সটা, আল্টা বা অনুরূপ কোন শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংশোধনীতে ব্যক্তির পাশাপাশি কোম্পানিকে জরিমানার বিধান এবং জরিমানার পরিমাণ ২ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। একই ব্যক্তি কর্তৃক দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে দ্বিগুন হারে জরিমানার বিধান রয়েছে।
সংশোধনীর অন্যান্য বিষয়াবলী:
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে অপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের নিকট তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য ক্রয় ও বিক্রয় নিষিদ্ধ, অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিন স্থাপনে জরিমানা, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল প্রতিষ্ঠা, তামাক ও তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে নীতিমালা প্রণয়নে বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে ভাবনা
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ সংশোধনের সিদ্ধান্ত মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে। অনেকেই প্রত্যাশা করেছেন এ আইন সংশোধনের প্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরো জোরদার হবে। মানুষের এই প্রত্যাশা পুরণের লক্ষ্যে আইনটি বাস্তবায়নে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহন প্রয়োজন।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষকে তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা। তাই সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ অপেক্ষা আইনটি পালনে মানুষকে কিভাবে উৎসাহী করা যায় সে বিষয়টি পরিকল্পনায় রাখা প্রয়োজন। অপরদিকে কোম্পানির ক্ষেত্রে আইনটি কঠোর প্রয়োগ বিষয়ে পদক্ষেপ জরুরি। বিগত সময়ে দেখা গেছে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যক্তিকে ধূমপানমুক্ত স্থানে ধূমপানের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ধারা ভঙ্গ করার জন্য তামাক কোম্পানিগুলোকে জরিমানা বা শাস্তি প্রদান করা হয়নি। ফলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তরুণ সমাজকে উদ্ধুদ্ধ করার প্রচেষ্টা তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ ও জনগনকে অবহিত করা
আইনটি সংশোধনের পর বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। আইনের অনেক ধারা রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়নের পুর্বে জনগণকে প্রস্তুত করা জরুরি। ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত ধারা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর উপকরণ বা অবকাঠামো তৈরি প্রয়োজন রয়েছে। প্যাকেট বা মোড়ক সংক্রান্ত ধারা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রস্তুতি প্রয়োজন। সংশোধনীতে নিষিদ্ধ তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন অপসারণের জন্য স্বল্পতম সময় বেধে দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া প্রয়োজন। এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম আইন বাস্তবায়নের পথকে সহজ করবে।
আইনটি জাতীয় সংসদে পাশের পর সরকারীভাবে ব্যাপক প্রচারণা চালানো জরুরি। যাতে মানুষ আইনটি পালনের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারে। বিগত আইনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে আইন পাসের পর দ্রুত আইন কার্যকর করার ঘোষনা হয়েছে। কিন্তু আইনের বিধি তৈরি হয়েছে এক বছর পর। ফলে আইন প্রয়োগের বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতার কারণে আইনটি বাস্তবায়নে ধীর বা জটিলতা সৃষ্টি হয়। একবার আইনভঙ্গ করার প্রবণতা সৃষ্টি হলে তা পালনে মানুষকে উৎসাহী করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সচেতনতা বৃদ্ধি, উপকরণ তৈরি ও অবকাঠামো উন্নয়ন
বাংলাদেশে ৪ কোটির বেশি মানুষ তামাক ব্যবহার করে। এ আইন বাস্তবায়নের সাথে এই বিশাল জনগোষ্ঠী সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আইন পালনে উৎসাহী করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে কমলাপুর বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রেল স্টেশন। এ স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন ৫০,০০০ হাজারের বেশি মানুষ চলাচল করে। যাদের একটি বড় অংশ নিরক্ষর বা সাধারণ মানুষ। এই বিশাল স্টেশনটি আইন অনুসারে ধূমপানমুক্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ধূমপানমুক্ত সাইন নেই যাতে বোঝা যাবে এ স্টেশনের কোথাও ধূমপান করা যাবে না। দেশের বাকী স্টেশনগুলোর অবস্থা অনুমান করা যায়।
২০০৫ সালের আইনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, আইনটি পাশের পর প্রথমদিকে সরকারীভাবে জনসচেতনতা কার্যক্রম খুবই সীমিত ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোর রিপোর্টিং সচেতনতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া বেসরকারী সংগঠনগুলো ব্যাপক প্রচারণা চলায়। তবে বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ধূমপানমুক্ত স্থান সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। অনেকের মাঝে এখনো ভুল ধারণা কাজ করে আইনে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর এ ধারণা থেকেই আইনটির সফলতা আর বিফলতা নির্ণয় করে থাকে।
এ আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষকে তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা। মানুষকে আইন পালনে উৎসাহী করতে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পর্যাপ্ত ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সাইন মানুষকে নিজ হতে আইন মানতে উৎসাহী করবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বর্তমান সংশোধনীতে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপনের দায়িত্ব পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের কর্তৃপক্ষের উপর অর্পন করা হয়েছে। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত স্থান রক্ষায় কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়ে বিধি তৈরির জন্য সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর করার পূর্বে পাবলিক প্লেস ও পরিবহন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন এবং কর্তৃপক্ষকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।
দক্ষতা বৃদ্ধি ও সমন্বয় সাধন
২০০৫ সালের আইন অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এবং পুলিশের এ এস আই পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যেহেতু নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে তাদের এ আইন বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে অপর দুই কর্মকর্তার এ আইন বাস্তবায়নে ভূমিকা সুস্পষ্ট ছিল না বিধায় আইন বাস্তবায়নে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহন পরিলক্ষিত হয়নি। এসব কর্মকর্তার কাজের পরিধি ও দায়িত্ব সম্পর্কে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ক্ষমতায়ন করা হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন মোবাইল কোর্টই ছিল ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়নে একমাত্র পন্থা। তবে পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক সংস্থাই নিজস্ব ও অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান ধূমপানমুক্ত করার মাধ্যমে এ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, যা প্রশংসার দাবিদার।
ধূমপানমুক্ত স্থান বিষয়ে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হলেও, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ এবং প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বিধান বাস্তবায়নে পদক্ষেপ ছিল খুবই সীমিত। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধে উল্লেখ্যযোগ্য কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের বিধান সম্পর্কে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাজের পরিধি ও দায়িত্ব সম্পর্কে দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব হতো।
বর্তমান সংশোধনীতে আইনটির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বৃদ্ধি পাবে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সম্পৃক্ত হবে বিভিন্ন সংস্থা। আর এ বিষয়গুলোর সমন্বয় সাধন আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইন সম্পর্কে কোন অস্পষ্টতা হলে কোথায় যোগাযোগ করবে, আইনটি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাগুলো কিভাবে সমাধান করবে, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কর্মএলাকা বা কাজের পরিধি নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে একটি সহযোগি সংস্থা জরুরি। সংশোধনীতে প্রস্তাবিত জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এ ক্ষেত্রে আমাদের আশার আলো। সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের জনগন ও কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো কার্যকর করার সময় নির্ধারণের পূর্বে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের কাঠামো চুড়ান্ত ও কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরি।
ধূমপানমুক্ত স্থান সংক্রান্ত বিধানে সহজ বাস্তবায়ন
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়নে ২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। প্রথমত ধূমপানমুক্ত স্থানে ধূমপানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির জরিমানার বিধান করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত পাবলিক প্লেস বা পরিবহন ধূমপানমুক্ত রাখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ, তত্ত¦াবধায়কের উপর অর্পন করা হয়েছে। নতুন নতুন স্থান আইনে যুক্ত করার পাশাপাশি এ ধরনের বিধান আইনের পরিধি ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি করেছে। তাই আইনটি বাস্তবায়ন নিশ্চিতে নতুন পন্থা বা উপায়ের বিষয়ে চিন্তা জরুরি।
পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের জন্য জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট একটি প্রচলিত পদ্ধতি। তবে দেশের সব পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে সব সময় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা আদায় সম্ভবপর নয়। যেমন চলন্ত লঞ্চ, মধ্যরাতে কোন পাবলিক প্লেস বা পরিবহন বা গ্রামের কোন পাবলিক প্লেস বা পরিবহন। সামাজিক, মানবিক, সীমিত লোকবলসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কোন ব্যক্তি পাবলিক প্লেস বা পরিবহনে ধূমপান করলে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক তাদের গ্রেফতার করে সুদীর্ঘ পথ পারি দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট উপস্থিত করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এ সমস্যা হতে উত্তরণে আইনটি বাস্তবায়নে জনসাধারণকে স্বউদ্যোগে জরিমানা প্রদানে উৎসাহী করার কার্যক্রম চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল একটি নম্বর (৩১০৫) থাকবে, যা একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের। কোন কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন ব্যক্তিকে ধূমপানমুক্ত স্থানে ধূমপানরত অবস্থায় দেখতে পেলে, তাকে আইন লঙ্গনের বিষয়ে অবহিত করে, আইনে বর্ণিত শাস্তি পালনে ২টি প্রস্তাব করবেন। প্রথমত তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে স্বেচ্ছায় (৩১০৫) নম্বরে মোবাইলের মাধ্যমে জরিমানা প্রদান করতে পারে। স্বেচ্ছায় এ আইনের জরিমানা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিমাণ ২০০ (দুইশত) টাকা। যদি ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জরিমানা প্রদান করে তবে তার মোবাইলে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট হতে নির্দিষ্ট ফরমেট জরিমানা আদায় সংক্রান্ত তথ্য চলে আসবে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে যদি অভিযুক্ত স্বউদ্যোগে জরিমানা প্রদানে অস্বীকার করেন তবে তাকে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট অভিযোগ প্রমাণ ও জরিমানা আদায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে জরিমানার পরিমান ৩০০ (তিনশত) টাকা।
পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান নির্ধারনের বিধান এখনো বলবৎ রয়েছে। আইনের এই বিধান ধূমপানমুক্ত স্থানের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের সন্নিকটে বা অভ্যন্তরে কোনভাবেই ধূমপানের স্থান রাখা যৌক্তিক নয়। বিগত দিনের মতো আইনের বিধির মাধ্যমে পাবলিক প্লেস ও পরিবহন সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে জরিমানা আদায়ে এ পদ্ধতির পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, রেষ্টুরেন্ট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাবলিক পরিবহনে ইত্যাদি স্থানে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন এবং ধূমপানমুক্ত রাখা বিধান বাস্তবায়নে বিকল্প চিন্তা জরুরি। পাবলিক পরিবহনের ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়নে ট্রাফিক সার্জনদের ক্ষমতায়িত করার চিন্তা করা প্রয়োজন। এছাড়া কারাখানা পরির্দশক, স্যানিট্যারি অফিসার, শিক্ষা কর্মকর্তাদের কিভাবে এ আইন বাস্তবায়নে ক্ষমতায়িত করা যায় তাও ভাবনা উচিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব হলে আইনের বাস্তবায়ন অনেক সহজ হবে।
আইনের সংশোধনীতে স্থানীয় সরকারকে ধুমপানমুক্ত স্থান ঘোষণার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার কিভাবে ধুমপানমুক্ত স্থান ঘোষণা করবে, কারা কিভাবে এ আইন বাস্তবায়ন করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা থাকা জরুরি। অন্যথায় আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আইন সম্পর্কে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।
আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অভিযোগের সুবিধা :
তামাকজাত দ্রব্যের আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলে ফ্যাক্স, ইমেইল বা চিঠির মাধ্যমে অভিযোগ প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই অভিযোগ কেন্দ্র সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক সচেতন করা যেতে পারে। যাতে মানুষকে আইনভঙ্গের বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করে। এ প্রক্রিয়া সরকারের আইন মনিটরিং ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সহজতর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করবে।
তামাক ও তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ: ২০০৫ সালের আইনের তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের বিধান ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই নীতিমালা প্রণয়ন হয়নি। সংশোধিত আইনের তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ, শিল্প স্থাপন, তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করার জন্য যে সকল নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, তা প্রনয়ণের কাজ শুরু থেকে করা উচিত। এ সকল নীতিমালা প্রনয়ণের ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্তকরণ থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে নেতৃত্ব নেয়া উচিত।
পরিসমাপ্তি: ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ সংশোধনে পদক্ষেপ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা প্রত্যাশা করি এ আইনের কার্যকর বাস্তবাযন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে। দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে সরকারকে এ আইন বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।
প্রবন্ধটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন: বাস্তবায়নে ভাবনা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক, ২০ এপ্রিল ২০১৩, বিলিয়া অডিটরিয়াম এ উপস্থাপন করা হয়