সৈয়দ মাহবুবুল আলম, আইনজীবী ও নীতিবিশ্লেষক
প্রতিদিন এই শহরে গাড়ীতে উঠা, অতিরিক্ত ভাড়া, নিরাপদের রাস্তা পারাপারে অসংখ্য মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এই মানুষগুলোর সংখ্যা শতকরা ৯৫% ভাগ। অথচ যানজট নিরসনের নামে পরিকল্পনায় আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধা পায় ৫% মানুষ। প্রাইভেট গাড়ীর জটকে আড়াল করতে যানজটের নামে একের পর এক পরিকল্পনা হচ্ছে, উপেক্ষিত হচ্ছে অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত। ফ্লাইওভার, পার্কিং, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এসকল প্রকল্পের সুবিধাভোগী পথচারী, বাসযাত্রী, রিকশাযাত্রী বা সাইকেল আরোহীরা নয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় ১৯% হেঁটে, ২৮.৫% বাসে, ৩৮.৭% রিকশায় এবং ৫.২% প্রাইভেট গাড়ীতে ট্রিপ হয়ে থাকে। তবে কেন জনগনের অর্থ খরচ করে এধরনের ব্যয় বহুল প্রকল্পে দীর্ঘসময় ধরে নগর যাতায়াত পরিকল্পনা ব্যস্ত আছে, তা বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনা করা জরুরি।
প্রতিনিয়ত রিকশা, পথচারী পারাপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ যাতায়াতের মাধ্যমগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে নিশ্চুপ থেকে কেন প্রকল্প তৈরিতে ব্যস্ত থাকা হয়? নগর পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা কেন এ কাজ করছেন তার কারণ খুজতে হবে। এ নগর শুধুমাত্র প্রাইভেট গাড়ীর জন্য নয়। প্রাইভেট গাড়ী যত বাড়বে, ততই বাড়বে যানজট। প্রাইভেট গাড়ীর জন্ম নিয়ন্ত্রণ একটি জরুরি ও অপরিহার্য বিষয়।
পাবলিক পরিবহন বাস উন্নত হলে, বাসভাড়া হ্রাস পেলে, পথচারী পারাপার নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হলে এ নগরের অধিকাংশ মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু নগর যাতায়াত পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলো উপেক্ষিত। বাস ভাড়া, পাবলিক পরিবহন, পথচারী পারাপার নিশ্চিত করার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান কাঠামো ও আইনী প্রয়োগের মাধ্যমেই এ সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। অথচ এই বিষয়গুলো প্রতি কোন নজর নেই। যানজট, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোর প্রকল্পের আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে যাতায়াত আলোচনার মূখ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্যের একটি প্রকৃত উদাহরণ হলো ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা। এই এলাকায় ধাপে ধারে চারপাশ হতে রিকশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তার নামে পথচারীদের পর্বত সমান ফুটওভারব্রিজ অতিক্রমে বাধ্য করতে কাঁটাতারে বেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় নিবিঘেœ প্রাইভেট গাড়ীর পার্কিং করা যায়। নিউমার্কেটে যারা কেনাকাটা করতে আসেন তাদের অধিকাংশরই গাড়ী নেই। প্রাইভেট গাড়ীর সুবিধাকে বহাল রেখে রিকশাযাত্রী ও পথচারীদের জন্য এধরনের একমুখো নীতি অত্যান্ত বৈষম্যমূলক ও অসংবিধানিক। এধরনের বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত জনমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি, জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করে।
ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় প্রতিনিয়ত নিষিদ্ধ হচ্ছে রিকশা। যানজট কারণ দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবেশবান্ধব বাহনটি বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ বর্তমান যানজটের মূল কারণ প্রাইভেট গাড়ী। এটি নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ নেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৮.৭% যাতায়াত হয় রিকশায়। নারীদের ক্ষেত্রে ৪৭.৪% এবং স্কুলে ৪১% যাতায়াত হয় রিকশায়। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক মানুষের যাতায়াতের কথা বিবেচনা না করেই বন্ধ করা হলো রিকশা। আমরা এতগুলো মানুষ কিভাবে যাতায়াত করবো তা কেন চিন্তা করা হলো না। রিকশার সাথে জড়িত এতগুলো মানুষের জীবনজীবিকা কিভাবে চলবে তাও ভাবা হয়নি। আমরা যারা রিকশায় চলি এবং যারা রিকশা চালায় তারাও এদেশের নাগরিক, আমরাও কর দেই । তবে আমাদের জন্য এ ধরনের বৈষম্যমূলক নীতি কেন? নাকি রিকশা যাত্রী ও পথচারীরা এ নগরে অবাঞ্চিত তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
এক সময় ঢাকার রাস্তায় পথচারী পারাপারে উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিকল্পনায় বলা হলো ফুটওভার ব্রিজ বা জ্রেবা ক্রসিং ছাড়া পারাপার করলে ২৪ ঘন্টার জেল। কিন্তু ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায় নেই জ্রেবা ক্রসিং। আর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ। যেগুলো একজন ক্লান্ত পথচারী, রোগী, গর্ভবতী মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী ও মালামাল বহনকারী মানুষের পক্ষে অতিক্রম করা কঠিন। তবে কিভাবে পথচারী রাস্তা পার করবে? গুটি কয়েক মানুষ প্রাইভেট গাড়ীতে বসে যদি সমতলে সহজে যেতে পারে। তবে তার চেয়ে বেশি সংখ্যার মানুষকে কেন সমতলে যাওয়ার সুবিধা প্রদান করা হবে না? ফুটওভার ব্রিজ তৈরি, পরিকল্পনা ও পরামর্শ প্রদানকারীদের জন্য অনুরোধ প্রতিদিন অন্তত একবার নিয়মিত এই ব্রিজগুলো মনিটরিং করার জন্য উঠুন। মানুষের কষ্ট অনুধাবন করুন, হাঁটার জন্য এই পর্বত অতিক্রম শুধু কষ্টদায়ক নয়, অনেকের জন্য জীবনের জন্য হুমকি।
এক সময় দেখলাম ঢাকা রাস্তা হতে ২০ বছরের পুরাতন বাসগুলোর অপসাধারনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বাসগুলোতে স্বল্প আয়ের অধিকাংশ মানুষ চলাচল করে। পুরাতন বাস অপসারণ করা হবে, ধরেই নিলাম ভাল সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ বাসগুলোর যাত্রী কিভাবে চলবে? তাদের কোন ব্যবস্থা না করেই বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কেন করা হলো? এতগুলো বাস চালক বা বাসের শ্রমিকের জীবন জীবিকা কি হবে? এ সমস্যাগুলো চিন্তা কখনোই করা হয় না। কয়েক দিন পর পর পুরাতন বাস বন্ধের ধোঁয়া তুলা হয়। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত এত সহজে আর সাহসিকতা সাথে আজো নিতে পারেনি।
এই শহরে প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহারকারী সংখ্যা মাত্র ৫%। বিআরটিএ এর তথ্যমতে, ২০০৩ সালে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কারের সংখ্যা ছিল ৮৭৮৬৬ এবং জিপ/মাইক্রোবাস ৩২৩৯১টি। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এর সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৪৭২৮৩ এবং ৫৮৬০৮। এখন ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১৫০-১৮০ টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। ঢাকার রাস্তা আজ প্রাইভেট গাড়ীর জটে অতিষ্ঠ। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে কোন উদ্যোগ নেই। বরং এই পরিবহনের নিরাপদ ও সহজে চলার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাইওভার, পার্কিং এবং এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তা যে কোন স্থানেই এই পরিবহন পার্কিং করা যায়। তার উপর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে প্রতিটি বাড়ীতে গাড়ীর জন্য পার্কিং করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিত্তশালী মানুষের পরিবহনের জন্য জনগনের অর্থ ব্যয় করে এতগুলো সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে, সাধারণ মানুষের পরিবহনের জন্য এত সীমাবদ্ধতা কেন চাপানো হচ্ছে তা সঠিকভাবে বিবেচনা করা উচিত।
এক ধরনের বৈষম্যমূলক পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত হতে মনে একটি প্রশ্ন আসে, তবে কি গাড়ীওয়ালা মানুষরাই এই নগরে থাকবে। আর যে সকল মানুষের গাড়ী নেই তাদের এই নগর ত্যাগ করতে হবে। অথবা পরিবহনের ক্ষেত্রে এই নির্যাতন আর অবজ্ঞা সহ্য করেই বসবাস করতে হবে। কেননা প্রাইভেট গাড়ীই হচ্ছে এই শহরের মনিব, আর মানুষ তার সেবাদাস।
যানজট একটি মাচমচে পরিচিত শব্দ। আর এই সমস্যা খুলে দিচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প, ঋণ বিনিয়োগ আর ব্যবসার দ্বার। যানজট নিরসনের জন্য বিভিন্ন পরিবহন নিষিদ্ধ, একের পর এক গবেষণা প্রকল্প, সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিবর্তন, ফ্লাইওভার, ওভার পাস, ফুটওভারব্রিজ নানা প্রকল্প হল। কিন্তু সমাধান আসেনি, বরং বেড়েছে যানজট বেড়ছে মানুষের যাতায়াত খরচ ও দূর্ভোগ। অথচ প্রতিটি প্রকল্পে বলা হয়েছে যানজট সমস্যার সমাধান হবে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে সংস্থাগুলো কর্তৃক এতগুলো প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য কোন মূল্যায়ণ হয়নি, তাদের জবাবদিহীতার মুখোমুখি হতে হয়নি।
যানজট নিরসন প্রকল্পগুলোর ব্যর্থতার জন্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হোক। মূল্যায়ণ করা উচিত বৈষম্যমূলক নীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের অধিকার কেন লঙ্গন করা হয়েছে? একদিকে প্রাইভেট গাড়ীর বৃদ্ধিকে অব্যাহত রেখে, যানজটের অজুহাতে রিকশা এবং বাসের মতো পরিবহন মাধ্যমগুলোর উপর কেন বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি নীতিনির্ধারকরা অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতি মনোযোগী হবে। তবেই পথচারী, বাসযাত্রী, সাইকেল আরোহী, রিকশাযাত্রী তথা অধিকাংশ মানুষ অগ্রাধিকার পাবে এবং প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণ হবে। যার সুফল এ নগরে ধনী-গরীব মধ্যবিত্ত সকলেরই পাবে।